যশোরে ৫ বছরে বন্ধ ২৫ সেমাই কারখানা
যশোরের শেখহাটি হাইকোর্ট মোড়ে ৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় জননী সেমাই মিল। প্রথম বছর ভালো ব্যবসা হওয়ায় বড় পরিসরে উৎপাদনে যেতে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী শচীন বিশ্বাস। কিন্তু পরের বছর থেকে হঠাৎই বাজারে খোলা সেমাইয়ের চাহিদা কমতে থাকে।
এরপর আসে করোনার প্রকোপ। তারপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এখন ঋণে জর্জারিত হয়ে বন্ধ হতে বসেছে জননী সেমাই মিল।
কোনোরকম গুটি কয়েক শ্রমিক নিয়ে চলছে কার্যক্রম। অর্ডার পেলে তবেই হচ্ছে উৎপাদন।
শচীন বিশ্বাস জানান, "বর্তমানে ভাজা ও লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা বেশি থাকায় আগের মতো খোলা সেমাই বিক্রি হচ্ছে না। এছাড়াও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। ব্যয় অনুযায়ী লাভ না হওয়ার কারণে অনেকেই মিল বন্ধ করে অন্য ব্যবসা শুরু করেছেন।"
একই অবস্থা যশোরের বিসিক শিল্প নগরীতে। গত ৪ বছরে এখনকার ফ্লাওয়ার মিলগুলোর অধিকাংশই সেমাই উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বর্তমানে জনতা সেমাই কল, সিটি ফ্লাওয়ার মিল, বিবি ফ্লাওয়ার মিল, পূর্বানী ফ্লাওয়ার মিল অর্ডার নির্ভর সেমাই উৎপাদন করছে।
পূর্বানী ফ্লাওয়ার মিলের ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, "দীর্ঘদিন ধরেই হাতে তৈরি সেমাইয়ের মার্কেট খারাপ। তবে এবছর বেশি প্রভাব পড়েছে। প্রতিবছর এমন সময় সেমাই শ্রমিকরা প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এ বছর চাহিদা না থাকায় সেই ব্যস্ততা কমেছে।"
তিনি জানান, রমজানের শুরু থেকে দিনে গড়ে ১,০০০ হাজার কেজি সেমাই বিক্রি হতো। কিন্তু এখই সেই বাজার নেমেছে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজিতে। এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে লাচ্ছা ও ভাজা সেমাই। ফলে চাহিদা কমেছে খোলা সেমাইয়ের।
এছাড়া, এককেজি সেমাই পাইকারি বিক্রি হয় ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়, যার উৎপাদন ব্যয় ৪২ থেকে ৪৮ টাকা। তার সাথে রয়েছে বাকি বিক্রি। তাছাড়া, হাতে তৈরি খোলা সেমাইয়ের তুলনায় বাজারে ভাজা সেমাই এবং বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির সেমাইয়ের চাহিদা বেশি।
যার কারণে যশোরে গত ৫ বছরে ২৫টির বেশি হাতে তৈরি খোলা সেমাইয়ের কারখানা বন্ধ হয়েছে।
এরমধ্যে শহরের জামরুলতলা এলাকার ফয়সাল সেমাই, ছোট শেখহাটির কুসলুম সেমাই ঘর, ঝুমঝুমপুর বটতলার মা ফ্লাওয়ার এন্ড সেমাই, বিসিকের সিটি ফ্লাওয়ার, রিমন ফ্লাওয়ার এন্ড সেমাই, রাজারহাটের ওহিদ ফ্লাওয়ার এন্ড সেমাই উল্লেখযোগ্য।
যশোর বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি সাকির আলী বলেন, দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো সেমাই তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার পর ছোট বেকারিগুলো এ পণ্যের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, "একসময় স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই জনপ্রিয়তা পেলেও এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না মাঝারি বা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো। এর বাইরে আরও কিছু ব্যবসায়ী শুধু ঈদে সেমাই তৈরি করতেন। সেগুলোও এখন নেই। তারা খরচের সঙ্গে টিকতে পারছেন না।"
"এরমধ্যে এবছর ময়দা, চিনি তেলসহ অন্য সব উপকরণের দাম বাড়ার কারণে অনেকে লোকসানের আশঙ্কায় সেমাই তৈরি বন্ধ করে দিয়েছেন," যোগ করেন সাকির আলী।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও ভিন্ন স্বাদের কারণে জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্যাকেটজাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেমাই।
দেশে বছরে সেমাইয়ের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন, যার বেশিরভাগই এখন ব্র্যান্ডের দখলে। এক দশকের ব্যবধানে এ অবস্থান তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। দুই দশক আগেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই মানুষের ঘরে ঘরে দেখা যেত। কিন্তু ব্র্যান্ডের হাতে বাজার চলে যাওয়ায় আঞ্চলিক ছোট কারখানাগুলো এখন সেমাই তৈরিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এমনকি, এ ধরনের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
মুদি ব্যবসায়ী ফরিদ হোসেন বলেন, "ঈদ ঘিরে বাজারে দুই ধরনের সেমাই বেশি পাওয়া যায়। একটি লাচ্ছা সেমাই, অন্যটি চিকন সেমাই। লাচ্ছা সেমাই আবার তৈরি হচ্ছে ডালডা অথবা ঘিয়ে ভেজে। তবে দেশের মানুষের কাছে দুই ধরনের সেমাইয়েরই সমান কদর।"
শহরের বড় বাজারের সেমাই ব্যবসায়ী জয়দেব নন্দী বলেন, "দুই ধরনের সেমাইয়েরই চাহিদা বেশি। বিশেষ করে শহুরে মানুষ ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই বেশি পছন্দ করে। গ্রামে সাদা সেমাই বেশি চলে। আগে লাচ্ছা সেমাই খোলা বেশি চলতো, কিন্তু এখন প্যাকেট ছাড়া মানুষ নেয় না।"
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেমাইয়ের বাজার তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। এগুলো হলো- সাধারণ বেকারির তৈরি, এলাকাভিত্তিক ব্র্যান্ড এবং প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদিত সেমাই। বর্তমানে বড় কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। সারা বছর এসব কোম্পানির সেমাই বাড়ির পাশের দোকানে পাচ্ছেন ক্রেতারা।
এরমধ্যে রয়েছে প্রাণ, বনফুল, কিশোয়ান, কুলসন, এসিআই, বিডিফুড, বসুন্ধরা, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, ডেকো ও ওয়েল ফুডের সেমাই। বড় বিনিয়োগ, উন্নত প্রযুক্তি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অঙ্গিকারে এসব প্রতিষ্ঠানের সেমাই এখন গ্রাহক চাহিদার শীর্ষে।
এ বছর বাজারে সেমাইয়ের দাম কিছুটা বাড়তি। বিশেষ করে ২০০ গ্রামের সেমাইয়ের প্যাকেটের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আগে ২০০ গ্রাম প্রতি প্যাকেট সাদা সেমাই ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হলেও এবছর ব্র্যান্ডভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা।
একই পরিমাণ লাচ্ছা সেমাই ৪০-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০-৭০ টাকা।