এলসি বন্ধ থাকায় ঝুঁকিতে যশোরের মোটরপার্টস ব্যবসা
মোটরপার্টসের রাজধানী বলা হয় যশোর জেলাকে। কেননা এখানকার আমদানিকারকরা পার্টস আমদানি করে সারা দেশে বিক্রি করে থাকেন। প্রায় ২ হাজার দোকানির ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে পার্টসখাতে। করোনাকালে এসব ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ ছিল চরম আর্থিক ঝুঁকিতে। এখন ডলার সংকটে আমদানি করতে না পারার কারণে ব্যবসা তলানীতে ঠেকেছে। আবার ভারতীয় কোম্পানির ডিলারশিপ বাতিলের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
কেননা পার্টস আমদানি করতে না পারলে তারা ঢাকার ব্যবসায়ীদের ডিলারশিপ দিয়ে দিতে পারেন। বর্তমানে পণ্যের অভাবে ব্যবসা একপ্রকার বন্ধ থাকায় কর্মচারীদের বেতন দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের।
যশোর-খুলনা সড়কের ফারিয়া মোর্টরসের স্বত্বাধিকারী ও আমদানিকারক রোজোয়ান আহমদ মুরাদ জানান, "করোনায় গত ২ বছর ব্যবসা হয়নি। কোনরকম টিকে আছি। পুঁজি ভেঙ্গে কর্মচারীদের বেতন দিয়েছি। এখন এলসি করতে না পারার কারণে পণ্য আনতে পারছিনা। আবার ব্যাংক কোন ঋণ দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে ব্যবসার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছিনা।"
শহরের আরএন রোডস্থ নির্জন এন্টারপ্রাইজের মালিক মোঃ রানা জানান, "আমি মূলত থ্রি-হুইলার, ফোর হুইলার পার্টস আমদানি করে থাকি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রাহকরা এসে এসব পার্টস নিয়ে যান। কিন্তু গত ৬ মাস ধরে এলসি বন্ধ থাকার কারণে মালামাল আনতে পারছিনা। ব্যাংকের ঋণের কিস্তি, দোকান ভাড়া-বাড়ি ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিয়ে সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে আর এক-দুই মাস চললে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে।"
স্বপ্ন অটোর মালিক রাজু আক্তার বলেন, "আমরা মূলত ভারত থেকে বিভিন্ন কোম্পানির মোটরসাইকেলের পার্টস আমদানি করে সারা দেশে সরবরাহ করি। কিন্তু গত ৬ মাস ধরে এলসি বন্ধ থাকার কারণে পার্টস আমদানি করতে পারছিনা। এতে একে তো ব্যবসা হচ্ছেনা, আবার পার্টস আনতে না পারার কারণে ভারতীয় কোম্পানি পণ্য নিতে চাপ দিচ্ছে। তারা বলছে, পার্টস নিতে না পারলে ডিলারশিপ অন্য কোথাও দিয়ে দেয়া হবে।"
বাংলাদেশ মোটরপার্টস ও টায়ার টিউব ব্যবসায়ী সমিতি যশোর শাখার সভাপতি শাহিনুর হোসেন জানান, যশোরে প্রায় ২ হাজার মোটর ও মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান রয়েছে, যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। যার বেশিরভাগই ব্যাংক ঋণ।
২ হাজার দোকানে প্রায় ২০ হাজার কর্মচারী রয়েছে, যাদের বেতন ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
"কিন্তু এলসি করতে না পারার কারণে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছেনা। কিছু বড় ব্যবসায়ীর কাছে মালামাল থাকলেও আগামী একমাস পর তাও থাকবেনা। এতে সব ব্যবসায়ী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর উপর পীড়া দিচ্ছে ব্যাংকগুলোর কিস্তি পরিশোধ। মন্দা ব্যবসার কারণে বহু পার্টস ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েছেন।"
বেনাপোল কাস্টমের রাজস্ব আহরণের সিংহভাগ আসে উচ্চ শুল্কযুক্ত গাড়ির চেচিস ও মোটরপার্টস আমদানি থেকে। কিন্তু এলসি না হওয়ায় মোটর পার্টসের আমদানি কমে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কাস্টমের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ২ হাজার ৬৩১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বেনাপোল কাস্টম অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে বেনাপোল দিয়ে মোটরপার্টস আমদানি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, "গাড়ির চেচিস ও মোটরপার্টস আমদানি বেশি হলে রাজস্ব আহরণ বাড়ে। কম শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি হলে রাজস্ব কমবে এটা স্বাভাবিক। গত ৫-৬ মাস ধরে মোটরপার্টস আমদানি হচ্ছে না বললে চলে।"
রুপালি ব্যাংক যশোরের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম জানান, মূলত ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। যে কারণে ব্যাংকগুলোও তাদের ব্যবসা ঠিকমত করতে পারছেনা।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, "করোনার কারণে সব ব্যবসায় ধস নেমেছে। বেশি নেমেছে গাড়ির ব্যবসায়। যশোর শহরের আরএন রোড মোটরপার্টস ও মোটর সাইকলে পার্টসজোন হিসেবে সবস্থানে পরিচিত। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এলসি বন্ধ থাকার কারণে খাদ্যপণ্য ছাড়া সব আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যবসায়ীরা খেলাপি হচ্ছে, অন্যদিকে এ খাতে কর্মসংস্থান নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।"
বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার আবদুর রশিদ মিয়াও বলেন, এলসি না হবার কারণে দেশের ব্যবসায় মন্দা থাকায় মোটরপার্টস আমদানি কিছুটা কমেছে। যে কারণে রাজস্ব আয়ও আমাদের কমেছে।