ভারতীয় এলওসি-অর্থায়িত প্রকল্পের জন্য আরও ১.৬ বিলিয়ন ডলার চায় বাংলাদেশ
ভারতের তিনটি লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি)-এর আওতায় বাংলাদেশে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য অতিরিক্ত আরও ১.৬ বিলিয়ন ডলার তহবিলের প্রয়োজন।
চলমান প্রকল্পগুলোর খরচ বহনে তহবিল নিশ্চিতের জন্য ইতোমধ্যেই ভারতকে নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এমনটিই জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা।
তারা জানান, প্রস্তাবিত কাঠামোর অংশ হিসেবে ধীর গতিতে চলমান প্রকল্প বা যেগুলোকে এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো থেকে তহবিল নিয়ে এসে দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে, এমন প্রকল্পগুলোয় কাজে লাগানো হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইআরডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "আমাদের প্রাথমিক হিসাবে এলওসি প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত ১.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। তবে এর থেকে বেশিও প্রয়োজন হতে পারে। কারণ চলমান এবং প্রক্রিয়াধীন সকল প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।"
উদাহরণস্বরূপ ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ৬৬ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আগে এই প্রকল্পে ভারতীয় ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২৩৫.১ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, ১২ জেলায় আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পের জন্য ১৯৩ মিলিয়ন ভারতীয় ঋণ ছাড়াও এখন আরও ৪৭ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
আবার, বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাটিপাড়া-ভাঙ্গা সড়ক প্রকল্পে আগে ভারতীয় ঋণ ধরা ছিল ১০০ মিলিয়ন। কিন্তু এই প্রকল্পে এখন ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ভারতীয় ঋণের প্রয়োজন।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এলওসির অধীনে সবগুলো প্রকল্পে কী পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থায়নের প্রয়োজন হবে, তা জানতে ভারতীয় টেকনিক্যাল টিম বাংলাদেশ সফরে আসবে।
"আমরা চেয়েছিলাম, মার্চে ওই টিম আসুক। কিন্ত রমজানের কারণে ভারতীয় টেকনিক্যাল টিমের বাংলাদেশ সফর এখন এপ্রিলে হতে পারে," বলেন তিনি।
টিম আসার পর অতিরিক্ত অর্থায়নের পরিমা এবং উৎস সম্পর্কে জানা যাবে। এক্ষেত্রে ধীরগতির প্রকল্প থেকে অর্থ কাটছাট করে অতিরিক্ত অর্থায়ন যোগান দেওয়া হবে, না-কি নতুন করে ভারত ঋণ দেবে, সে সিদ্ধান্ত তখনই আসতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের প্রকল্প মনিটরিং কমিটির তৃতীয় বৈঠকে উভয় দেশের কর্মকর্তারা প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সম্পর্কিত আলোচনা ও কাজের জন্য ভারতীয় টেকনিক্যান টিম বাংলাদেশ সফর করবে।
ওই বৈঠকে ভারতের দিক থেকে বিশেষ সচিব প্রভাত কুমার এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইআরডি সচিব শরিফা খান সহ-সভাপতিত্ব করেন।
নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ ও গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা প্রকল্প-ভিত্তিক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভারতও প্রকল্প-ভিত্তিক গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে বর্তমান ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এলওসি প্যাকেজের অধীনে যেকোনো প্রকল্পে ঋণ বিতরণের সাথে সাথেই পুরো ঋণের সময়ের হিসাব শুরু হয়।
একটি এলওসি প্যাকেজে সর্বোচ্চ ১৫টি প্রকল্প থাকতে পারে। একবার একটি প্রকল্প শুরু হয়ে গেলেই গ্রেস পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়।
ভারতীয় টেকনিক্যাল টিম আসার পর বিদ্যমান তিন এলওসি-এর জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে। যেসব প্রকল্প এবং চুক্তি ওই সময়সীমা অতিক্রম করে যাবে, সেগুলো নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে স্থানান্তর করা হবে বলে জানা গেছে।
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নতুন ব্যবস্থায় প্রকল্পগুলোকে নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্রভিত্তিতে পরিশোধের সময়সীমা দেওয়া হবে। বর্তমান আলোচনার অধীনে থাকা নতুন প্রকল্পগুলোকেও বৃহত্তর এই ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির অধীনে এনে পৃথকভাবে প্রকল্প-ভিত্তিক অর্থায়ন চুক্তি চূড়ান্ত করা হতে পারে।
এলওসি-অর্থায়নে প্রকল্পগুলোর অবস্থা
ভারতীয় তিন এলওসি-এর অধীনে ৪২টি প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি ২৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে ৮টি ভৌতকাজ পর্যায়ে এবং ১১টি টেন্ডারিং পর্যায়ে রয়েছে। আর কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন জটিলতা বিবেচনায় এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তিনটি লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি)-এর অধীনে বাংলাদেশকে ভারত ৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইআরডি তথ্যমতে, গেল ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিশ্রুত অর্থের ১৮.২ শতাংশের কিছু বেশি দিয়েছে দেশটি।
বাস্তবায়নে দেরি ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণ
ইআরডি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে, এলওসি প্রোগ্রামের অধীনে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ভারতের কাছ থেকে সম্মতি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে।
উচ্চ-পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠকে এলওসি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বাড়তি তহবিলের সঠিক পরিমাণ দ্রুত জানাতে বলেছিলেন ইআরডি কর্মকর্তারা। যাতে করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়।
বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রথম ভারতীয় এলওসি'র আওতায় বাস্তবায়িত হতে যাওয়া ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু ভারতীয় ঠিকাদার কোম্পানি এই মুহূর্তে কাজ না করায় একই এলওসির অধীনে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ প্রকল্পে কোনো অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। সুতরাং, কুলাউড়া-শাহবাজপুর প্রকল্পের তহবিল ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইআরডি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রয়োজন। ভারতও ইআরডিকে আশ্বস্ত করেছে, যত দ্রুত সম্ভব অনুরোধটি তারা মূল্যায়ন করবে।
ঢাকা-জয়দেবপুর প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। প্রকল্পের কাজ তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা শেষ করতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ, ১৫ বছরে শেষ হবে প্রকল্পটি।
রেলওয়ে কর্মকর্তাদেরকে প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া জানিয়েছেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ সঠিকভাবে না হওয়ায় বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৬৫ শতাংশ এবং ব্যয় বাড়িয়ে ৩,২৬৫.৭৬ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা মূল প্রাক্কলের তুলনায় চারগুণ।
এদিকে, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন প্রকল্পের ব্যয় আবারও বাড়বে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা। ২০১১ সালের জুনে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিউল। ২৫ শতাংশ অগ্রগতির পর প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
প্রকল্প পরিচালক মোঃ সুলতান আলী বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনার কারণে এ প্রকল্পের অগ্রগতি থেমে আছে। প্রকল্পটির মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে এবং এখন দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ রেলওয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর রেললাইনের কাজের জন্য টেক্সম্যাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কালিন্দি রেল নির্মাণের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের মে মাসে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
উচ্চ-পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠকে দুর্বল অগ্রগতির কারণ দেখিয়ে ইআরডি জানায়, টেক্সম্যাকোর চুক্তি বাতিল করাই উত্তম হবে। কারণ এই প্রকল্পের ধীরগতির কারণে এলওসি-১ আরও পিছিয়ে যাচ্ছে; তাই বর্তমান চুক্তিটি বাতিল করে আরেকটি নতুন চুক্তি বা প্রকল্পের অধীনে নিয়ে এই প্রকল্পে ভারসাম্য আনা ভাল সিদ্ধান্ত হবে।
এদিকে, আশুগঞ্জ-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া সড়ক প্রকল্পটিও ভারতীয় ঠিকাদারের অর্থ সংকটে ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এছাড়া, আশুগঞ্জ ইনল্যান্ড কন্টেইনার রিভার পোর্ট (নদী বন্দর) প্রকল্পের ব্যয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন প্রকল্পের দরপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে ব্যয় বেড়েছে। বিলম্বিত এই প্রকল্পটি সংশোধনের একটি প্রস্তাব সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ৪,০৫২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০,২৪৭ কোটি টাকা করা হয়েছে। এরমধ্যে ভারতীয় ঋণ ২,০৫০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬,৩৭৩ কোটি টাকা।
ধীরগতির প্রকল্প
ইআরডি কর্মকর্তাদের মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিহ্নিত ধীরগতির প্রকল্পগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের বে কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প (৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ), সৈয়দপুর বিমানবন্দর প্রকল্প (৩৭৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ) এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে ক্যারিজ ওয়ার্কশপ প্রকল্প (৩৭৫ ডলার মিলিয়ন ঋণ) প্রস্তাবিত নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির অধীনে চলে যেতে পারে।
এদিকে, টেলিটক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা উন্নত করতে বা 'হার্ড-টু-রিচ' এলাকায় নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিতে সৌরশক্তি-ভিত্তিক স্টেশন নির্মাণের প্রকল্পটি (৩০ মিলিয়ন ডলার ঋণ) স্থায়ীভাবে বাদ দেওয়া হতে পারে। কারণ এই প্রকল্পে নির্মিতব্য ৪২০টি টাওয়ারের প্রায় অর্ধেকই চলমান অন্যান্য প্রকল্পের অধীনে নির্মিত হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, একই ধরনের জটিলতায় বেশ কয়েকটি প্রকল্প ভারতীয় এলওসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। আরও কিছু প্রকল্প বাদ পড়তে পারে।
জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং একটি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি যশোর, কক্সবাজার, পাবনা ও নোয়াখালীতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পও এলওসি তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে সরকার।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়িত হবে না।