দাম বৃদ্ধির পরেও আগামী অর্থবছর ভর্তুকি বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সারে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্ত পূরণের জন্য সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কয়েক দফা বাড়ানোর পরেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব খাতে ভর্তুকি বাবদ বাড়তি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটাতে নতুন অর্থবছরের এই বাড়তি বরাদ্দের অর্থ ব্যয় হবে।
তবে আগামী অর্থবছরে নিট ভর্তুকি কমানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণখাতে ৮১,৪৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে সরকার। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব খাতে মোট বরাদ্দ বাড়িয়ে ১,০৫,০০০ কোটি টাকা রাখা হতে পারে। নতুন অর্থবছরে নিট ভর্তুকির পরিমাণ এবারের চেয়ে না বাড়লেও মূলত চলতি অর্থবছরের ভর্তুকির বকেয়া মেটাতেই বাড়তি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছে ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন পরিস্থিতি প্রথমবারের মতো পর্যালোচনা করতে সফররত আইএমএফ কর্মকর্তারা।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে আইএমএফ প্রশ্ন তুলেছে।
"তবে আমরা জানিয়েছি যে, এবারের তুলনায় আগামী অর্থবছরে নিট ভর্তুকির পরিমাণ অনেক কমে যাবে। তবে এবারের ভর্তুকির চাপ সামাল দিতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া দরকার, তা বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। ফলে বিভিন্ন খাতে বকেয়া থেকে যাচ্ছে, যা আগামী অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ দিয়ে মেটানো হবে," যোগ করেন তিনি।
আইএমএফ এর ঋণের শর্ত অনুযায়ী, কৃষি, খাদ্য ও রপ্তানিতে ভর্তুকি, সামাজিক নিরাপত্তা, পেনশন ও গ্র্যাচুইটিজ খাতে চলতি অর্থবছর বরাদ্দ আছে ১,৮২,৬০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ হবে ১,৮২,৩০০ কোটি টাকা।
কিন্তু আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, রপ্তানি প্রণোদনা ছাড়াও পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ থাকছে প্রায় ২,৩০,০০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৭,০০০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ এ খাতে অতিরিক্ত ৩২,৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দাবি করার পর তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে ৯,২০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৩,০০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
অর্থাৎ, বিদ্যুৎখাতে এ বছর মোট ৪৯,৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন ছিল; মূল্য বৃদ্ধি ও বাড়তি বরাদ্দ মিলিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ পাচ্ছে ৩১,২০০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ভর্তুকি বকেয়া থেকে যাচ্ছে।
এবার তিনবার দাম বাড়ানোর পর আগামী জুনের মধ্যে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়বে। তাতে আগামী বছর এখাতে নিট ভর্তুকির চাহিদা কমে যাবে। কিন্তু এবারের ভর্তুকি বকেয়া থাকার কারণে তা পরিশোধের জন্য নতুন বাজেটে এখাতে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
একই অবস্থা সারের ক্ষেত্রেও। গত অর্থবছরের বাজেটে কৃষি ভর্তুকিতে ৯,১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু সারের দাম বাড়ায় গত অর্থবছর ২৮,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ১৫,১৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ফলে গত বছরের কৃষি ভর্তুকিতেও ঘাটতি থেকে যায়।
এ বছর এখাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৬,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত ৪০,২৪৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দাবি করে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে এ বছর কৃষিখাতে ভর্তুকি মেটাতে ৫৬,২৪৭ কোটি টাকার দরকার হয়। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে এখাতে রাখা হয়েছে ২৬,০০০ কোটি টাকা। ফলে এবারের কৃষি ভর্তুকির বড় অংশই বকেয়া থেকে যাচ্ছে।
সরকার এরই মধ্যে সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সাশ্রয় হবে ৭,০০০ কোটি টাকা। ফলে এবারের চেয়ে নতুন অর্থবছরে এখাতে ভর্তুকির চাহিদা কমবে। কিন্তু বকেয়া দায় মেটাতে আগামী অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে প্রায় ২৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, সার, খাদ্যপণ্য ও গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভর্তুকির চাহিদা মোট বরাদ্দের দ্বিগুণের বেশি হতে থাকে। ফলে মন্ত্রণালয়গুলো চলতি অর্থবছরে এখাতে মোট ১,৮৬,৫৯৫ কোটি ভর্তুকি দাবি করে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দাম বাড়ানোর পাশাপাশি সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পরও এ বছর জ্বালানি তেল বাদে বিভিন্নখাতে প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার ভর্তুকি বকেয়া থেকে যাচ্ছে, বরাদ্দের অভাবে যা পরিশোধ করতে পারছে না মন্ত্রণালয়গুলো।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৫,৯৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, সংশোধিত বাজেটে এখাতে অতিরিক্ত ৮১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে খাদ্যে ভর্তুকিতে ৮,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে।