ইউরোপের গ্যাসের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশেও মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা
চলতি বছরে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ নিয়ে বিশ্বে শুরু হতে যাচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতা, যার ফলে ব্যাপক চাহিদা থাকা ইউরোপের ভোক্তা ও কারখানাগুলোকে চড়া মূল্যে কিনতে হতে পারে গ্যাস।
এই পরিস্থিতিতে এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দরিদ্র উনয়নশীল দেশগুলো রয়েছে বাজার থেকে বাদ পড়ার ঝুঁকিতে। ঘাটতি পূরণে ইউরোপীয় দেশগুলো এশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দামের ওপরও প্রভাব পড়বে।
রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে জ্বালানি সংকট তীব্র হয়েছিল, তার পর প্রথমবারের মতো ইউরোপ পরবর্তী শীতের জন্য গ্যাস মজুতের লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে, নতুন এলএনজি সরবরাহ শুরু হওয়ার আগে গ্যাসের জন্য শেষ মুহূর্তে প্রতিযোগিতা বাড়তে পারে।
ইউরোপে এই শীতকাল পার করার জন্য যথেষ্ট গ্যাস মজুত থাকলেও, শীতের প্রকোপ এবং শুরুর দিকে কম দাম থাকার পরও মজুতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে তীব্র শীতের কারণে গ্যাস মজুত আরও কমেছে, আর সরবরাহ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। গেল বছর রাশিয়ার পাইপলাইন সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে।
ব্যাংক অফ আমেরিকার কমোডিটি স্ট্র্যাটেজিস্ট ফ্রান্সিসকো ব্ল্যাঞ্চ বলেন, 'এ বছর ইউরোপে জ্বালানির ঘাটতি থাকবে।' এর মানে হলো, বিশ্বের নতুন এলএনজি সরবরাহের প্রায় সবটাই রাশিয়ার গ্যাসের ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যবহার হবে।
ইউরোপকে তার চাহিদা পূরণ করতে প্রতি বছর আরও ১০ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করতে হবে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি, জানিয়েছেন এনার্জি অ্যানালিস্ট সল কভোনিক।
নতুন রপ্তানি প্রকল্পগুলো বাজারের সংকট কমাতে সাহায্য করতে পারে, তবে তা নির্ভর করবে এই সুবিধাগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির গতি কেমন হয় তার ওপর।
পরবর্তী শীতের জন্য গ্যাস মজুতের সীমিত বিকল্প থাকায়, ইউরোপকে এলএনজি শিপমেন্টের জন্য এশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করতে হতে পারে, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ব্যবহারকারী দেশগুলো অবস্থিত। এতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে, যা ভারত, বাংলাদেশ এবং মিশরের মতো দেশগুলোর পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
ইউরোপে গ্যাস ফিউচার (ভবিষ্যতে গ্যাস কেনার চুক্তি) এর দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি এবং ২০২৫ সালের শুরুতে তা সংকটের আগে সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি রয়েছে। এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব এশিয়াতেও পড়ছে, কারণ ইউরোপের গ্যাস দাম সাধারণত এশিয়ার এলএনজি দামের ওপরও প্রভাব ফেলে।
এনার্জি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান পোটেন অ্যান্ড পার্টনারস ইনক. এর বিশেষজ্ঞ জেসন ফিয়ার বলেছেন, 'যদি এশিয়া-প্যাসিফিকের গ্যাস মজুত কমে যায়, তাহলে দাম আরও বাড়বে এবং চালান নিয়ে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে।'
সব বিদ্যুৎ উৎপাদক এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গ্যাসের বিকল্প খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। বিশেষ করে জার্মানির জন্য এটি বড় সমস্যা, কারণ ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের আগে দেশটি তাদের গ্যাসের অর্ধেকের বেশি রাশিয়ার উপর নির্ভর করত।
উচ্চ উৎপাদন খরচের চাপে থাকা জার্মানির উৎপাদন খাতের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। দেশটির ২৩ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ডানপন্থী 'আল্টারনেটিভ ফর জার্মানি' দলটি জনমত জরিপে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, কারণ তারা সস্তা পাইপলাইন গ্যাস সরবরাহ পুনরায় চালু করে উৎপাদন খাতের প্রতিযোগিতা বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ইউরোপের উচ্চ দামে গ্যাস কেনার সামর্থ্যের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গ্যাসের চালান ইউরোপমুখী হয়েছে, যাতে তারা বেশি দামের সুযোগ নিতে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকার পরিস্থিতিও একই রকম। খরার কারণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় ব্রাজিল গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজতে হিমশিম খেয়েছে। আর আসন্ন শীতকালীন মৌসুমে আর্জেন্টিনাও গ্যাসের জন্য প্রতিযোগিতায় যুক্ত হতে পারে।
এদিকে মিশরেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। গত বছর দেশটি এলএনজি রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। গ্রীষ্মকালীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে দেশটি ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ পরিমাণে গ্যাস আমদানি করতে বাধ্য হয়েছিল। ব্লুমবার্গের শিপ ট্র্যাকিং তথ্য অনুযায়ী, এ বছরও মিশরকে গ্রীষ্ম পার করতে বেশ কয়েকটি গ্যাসের চালান প্রয়োজন হতে পারে।
গ্যাস রপ্তানিকারকদের জন্য এই সংকট মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করছে। পরামর্শক সংস্থা অ্যাকসেঞ্চারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওগান কোসে মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদনকারীরা উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ পেতে পারেন, ঠিক যেমনটি ২০২২ সালের সংকটময় সময়ে হয়েছিল।
বিশ্বজুড়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ সংকট নিরসনে আশার আলো দেখাচ্ছে ২০২৬ সাল। বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের প্রকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কেপলার বিশ্লেষক লরা পেজের মতে, রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং মিশরের গ্যাস রপ্তানি বন্ধের ফলে গত বছর উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল খুবই কম। উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে, যা সংকট আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি রপ্তানি এ বছর ১৫ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও উৎপাদন প্রক্রিয়া ধীরে এগোবে বলে সতর্ক করেছে চেনিয়ের এনার্জি। রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের কিছু প্রকল্পও বিলম্বিত হতে পারে।
এদিকে এশিয়ার বাজার কিছুটা শিথিল থাকায় ইউরোপে সরবরাহের সুযোগ বেড়েছে। চীন ও ভারত তুলনামূলক সস্তা বিকল্পের দিকে ঝুঁকেছে। তবে বাংলাদেশ উচ্চমূল্যের দরপ্রস্তাবের কারণে গ্যাস ক্রয়ে পুনর্বিবেচনা করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০২৬ সালের পর সরবরাহ সংকট কমতে শুরু করবে। কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ১৭৫ মিলিয়ন টনের বেশি এলএনজি সরবরাহ বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাসে ভূমিকা রাখতে পারে। ইউরোপীয় জ্বালানি বিশ্লেষক ফ্লোরেন্স শ্মিট বলেন, 'যদি বর্তমান প্রকল্প পরিকল্পনাগুলো কার্যকর থাকে, তবে ২০২৬ সালেই সংকট কাটতে শুরু করবে।'