তৃতীয় পর্যায়ে প্রণোদনা ঋণের বিতরণে শ্লথগতি
কোভিড সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া সংকটে টিকে থাকতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া সরকারের প্রণোদনা ঋণের তৃতীয় পর্যায়ে ছোট-বড় সকল ঋণ শ্লথগতিতে বিতরণ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৭.১৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের যথার্থ সদ্ব্যবহার না করে অন্য খাতে ব্যবহার, চাহিদা থাকলেও ঋণের নির্ধারিত সীমা থাকা, ছোট ঋণে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কম হওয়ায় ঋণের বিতরণ কম হচ্ছে।
কোভিড প্রণোদনা ঋণের প্রথম পর্যায়ে বড়-ছোট সকল প্যাকেজে ব্যাপক গতি থাকলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে ছোটদের চেয়ে বড় গ্রাহকরা ঋণ বেশি পেয়েছে। তবে তৃতীয় পর্যায়ের ছোট-বড় কোনো ঋণেই গতি আসছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প-সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রণোদনা ঋণের তৃতীয় পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। যদিও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই-১৩ মার্চ) প্রায় নয়মাসে ঋণ বিতরণ হয়েছে ২,১৫৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৭.১৯%।
এই প্রণোদনা প্যাকেজের প্রথম পর্যায়ে (মে ২০২০ হতে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত) ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩২,৭০৩ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার ৮১.৭৬%। এছাড়া, দ্বিতীয় মেয়াদে (জুলাই ২০২১ থেকে ৩০ জুন ২০২২) ঋণ বিতরণ হয়েছে ১২,৭০৩ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৩৮.৫০%।
গেল ২০২০ এর ২৩ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোভিড ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা দেওয়ার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করে। গ্রাহক পর্যায়ে এই ঋণের সুদহার হবে মাত্র ৪.৫%।
সার্কুলারে বলা হয়, বিদ্যমান কোনো শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ব্যাংক হতে তার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ মঞ্জুরীকৃত ঋণসীমার সর্বোচ্চ ৩০% ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে।
এছাড়া, কোনো প্রতিষ্ঠানের যদি ব্যাংকে ঋণ না থাকে তাহলে তাকে এই সুবিধার আওতায় ঋণ নিতে গেলে ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আওতায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ সীমা নির্ধারিত হবে। একইসঙ্গে তাদের ক্ষেত্রেও ব্যাংকের বিদ্যমান ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সীমার ৩০% এর বেশি হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি কারণে তৃতীয় পর্যায়ে এসে ঋণ বিনিয়োগ কম হচ্ছে। তার মধ্যে প্রথমটি হলো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রথম মেয়াদে তার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সীমার ৩০% ঋণসুবিধা ভোগ করলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়াদে এ স্কিমের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই, তাই অনেক গ্রাহকের ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও ঋণ পাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান এক ব্যাংকের ঋণসীমা পুরোটা পাওয়ার পর অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে এই সুবিধার আবেদন করছে, একইসঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান সুবিধাও নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের 'বিশেষ মনিটরিং ইউনিট' এর নজরে আসার পর অনেক ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে।
'কিছু কিছু গ্রাহকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এই খাত থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ঋণের দায় পরিশোধ করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরোপুরি নীতিমালা লঙঘন। এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত করে সরকারের পক্ষ থেকে সুদ ভর্তুকি বাতিল করে দেওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান তথ্য আড়াল করে ঋণ নিতে পারছে না যার ফলেও বিতরণ কমেছে।'
এদিকে ছোট ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রেও তৃতীয় পর্যায়ে ঋণ বিতরণ কম হচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই-১৩ মার্চ) প্রায় নয় মাসে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। যদিও আলোচ্য সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩,১৭৪ কোটি টাকা, যা তাদের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৫.৮৭%। এই পর্যায়ে এ স্কিম থেকে ঋণ সুবিধা পেয়েছে ২৭,৪৩৪টি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান।
যদিও কোভিডের প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার ৭৬.৯৩% ঋণ বিতরণ হয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে একই পরিমাণে লক্ষ্যমাত্রার ৭৫.৭৭% ঋণ বিতরণ হয়েছে। এ দুই পর্যায়ে সুবিধাভোগী ছিল ১,৮২,৮৯৬টি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান।
সিটি ব্যাংকের স্মল বিজনেস ডিপার্টমেন্টের প্রধান কামরুল মেহেদী টিবিএসকে বলেন, "কোভিড প্রণোদনা প্যাকেজের সিএমএসএমই ঋণগুলো ব্যাংকগুলোর নিয়মিত গ্রাহকের মধ্যে বিতরণ করতে হয়েছে, কারণ নতুন করে কোনো গ্রাহককে ঋণ দেওয়াটা কঠিন ছিল। আর এ ঋণটি ক্ষতিগ্রস্ত (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) প্রতিষ্ঠানগুলোর একবারের জন্য নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, যার কারণে দ্বিতীয়বার অনেক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা থাকলেও নেওয়ার সুযোগ ছিল না।"
তিনি আরও বলেন, "এই প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে স্লথ গতি থাকলেও স্কিমের আওতা ছাড়াই সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী।"
এছাড়া, একাধিক ব্যাংকের এসএমই বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণোদনা ঋণের নিয়ম হলো কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা না দিতে পারলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেওয়া হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে জামানত দেওয়ার মতো অবস্থা না থাকায় ঋণ নিতে আসেন না। এসব কারণে ছোট উদ্যোক্তারা কম ঋণ পাচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত সিএমএসএমই ঋণ নিয়ে করা রিপোর্টে দেখা যায়, গেল ২০২২ সাল জুড়ে ঋণ বিতরণ অনেক বেড়েছে।
২০২২ সালে কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (সিএমএসএমই) আউটস্ট্যান্ডিং লোন বা বকেয়া ঋণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১২.২২% হারে এ খাতে বকেয়া ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা; তার আগের বছর ৬.১% হারে এর পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার কোটি টাকা।
তবে ২০২৫ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, কোভিড-১৯ মহামারির আগে এই খাতে আউটস্ট্যান্ডিং লোনের প্রবৃদ্ধির হার বেশি ছিল, ২০১৭ সালে যা ১৭% ছাড়িয়ে যায়।
২০২০ সালে মহামারির মধ্যে ঋণ কম বিতরণের ফলে আউটস্ট্যান্ডিং লোনের প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পায়।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান টিবিএসকে বলেন, "সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ কম হওয়ার পেছনে ব্যাংক-গ্রাহক দুই দিক থেকেই কিছু জটিলতা রয়েছে। ব্যাংকগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে নানান ধরনের কাগজপত্র চাচ্ছে, যা এই ধরণের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সিএমএসএমই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা কমিয়ে আনলে এসএমই খাত ব্যাপক গ্রো করবে।"
তিনি আরও বলেন, "দেশে এখন সিএমএসএমই-দের নিয়ে সেন্ট্রাল ডেটাবেজ নেই।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, "বঙ্গবাজারে যে পরিমাণ ছোট ছোট উদ্যোক্তা রয়েছে, তাদের ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া কেমন হবে? কারণ তাদের কাছে ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র নেই। এক্ষেত্রে সেন্ট্রাল ডেটাবেজ থাকলে তাদের ঋণ পাওয়ায় এত সমস্যা তৈরি হতো না।"
"আমাদের দেশের সিএমএসএমই খাত জিডিপিতে ২০-২৫% অবদান রাখছে। অথচ অন্যান্য দেশে সিএমএসএমই খাত মোট জিডিপির ৫০-৬০% অবদান রাখে", যোগ করেন তিনি।