প্রকল্প অর্থায়ন নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসছে এনডিবি প্রতিনিধি দল
বাংলাদেশে ক্লিন এনার্জি এবং এনার্জি এফিসিয়েন্সি, পরিবহন অবকাঠামো, পানি ও স্যানিটেশন, পরিবেশগত সুরক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো, এবং ডিজিটাল অবকাঠামো খাতে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা করতে চলতি সপ্তাহে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) একটি প্রতিনিধিদল দেশে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
১৮ থেকে ২৬ মে এর মধ্যে বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সাথে বৈঠক করবেন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, এনডিবি দেশের আটটি প্রকল্পের জন্য ২.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে আগ্রহী; তাদের আলোচনাতেও থাকবে বিষয়টি। এনডিবির সদর দপ্তর সাংহাইতে অবস্থিত।
কর্মকর্তারা আরো জানান, প্রতিনিধিদলের সফরকালে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়ারেজ অথরিটি (ওয়াসা)'র পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য ২৩৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চূড়ান্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, সেতু বিভাগের অধীনে তিনটি প্রকল্প- পায়রা, বিষখালী ও কারখানা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থায়নের বিষয়টি এ সফরের সময় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিনিধিদলটি রাজশাহীতে একটি পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য ৮৩ মিলিয়ন ডলার, রায়পুরায় ১২০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১১৫ মিলিয়ন ডলার এবং নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ প্রকল্পের জন্য ১১২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়েও আলোচনা করবে।
পশ্চিম অঞ্চলে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ২০৩ মিলিয়ন ডলার ঋণের উপরও জোর দেওয়া হবে আলোচনায়।
ইআরডি কর্মকর্তারা আরও জানান, এনডিবি বিভিন্ন খাতে ঋণ প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ক্লিন এনার্জি এবং এনার্জি এফিশিয়েন্সি, পরিবহন অবকাঠামো, পানি ও স্যানিটেশন, পরিবেশগত সুরক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো এবং ডিজিটাল অবকাঠামো।
এ কারণে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে নতুন প্রকল্পের তালিকা চেয়েছে ইআরডি। প্রায় ৩৫টি সরকারি সংস্থাকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে তারা।
ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আপাতত ঢাকা শহরের নতুন ১৬টি ওয়ার্ডে পানি সরবরাহের প্রকল্পের জন্য এনডিবি থেকে ঋণ নেওয়া হবে।
কিন্তু বৈশ্বিক বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অস্থির থাকায় বর্তমানে অন্যান্য প্রকল্পের জন্য এসওএফআর হারে ঋণ নাও নেওয়া হতে পারে। তবে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে যাতে এসওএফআর হার কমে গেলে এই প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ নেওয়া যেতে পারে।
এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের (এআইআইবি) মতোই এনডিবি ফ্লোটিং ইন্টারেস্ট রেটসহ ঋণ দেয়। এই হার এসওএফআর+১.৩০% থেকে এসওএফআর+১.৬৫% পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া, এক্ষেত্রে ০.২৫% ফ্রন্ট-এন্ড ফি এবং ০.৬৫% কমিটমেন্ট ফি রয়েছে।
বিপরীতে, এআইআইবি এসওএফআর+০.৭৯% থেকে এসওএফআর+১.২৯% ও ০.২৫% ফ্রন্ট-এন্ড এবং ০.৬৫% কমিটমেন্ট ফি-তে ঋণ দেয়।
ইআরডি'র অনুমান অনুযায়ী, এনডিবি থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ এআইআইবি থেকে ০.৫১% বেশি কারণ এনডিবি একটি কম ক্রেডিট রেটিংযুক্ত নতুন ব্যাংক।
ইআরডি কর্মকর্তাদের মতে, এনডিবি ঋণ মার্কিন ডলার এবং চীনা ইউয়ান উভয় মাধ্যমেই পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রকল্পের মতো এক্ষেত্রে ব্যয়ের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা থাকবে না। বরং বাংলাদেশ তাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী এনডিবি ঋণের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে। তাছাড়া, অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের মতো এনডিবি'র কোনো প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ার নির্দেশিকা নেই।
এনডিবি থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশের ১ থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে ইআরডি কর্মকর্তারা।
তারা আরো জানান, ২০২২-২৬ সময়ে জন্য এনডিবি'র ৩০ বিলিয়ন ডলারের পোর্টফোলিও থেকে বাংলাদেশের ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত তহবিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৪ সালে নতুন এই উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে চীন। পাঁচটি প্রধান উদীয়মান অর্থনীতি- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার- ছয়টি উন্নয়ন অর্থায়ন খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাংকটি।
২০১৭-২১ সময়ে ব্রিকস ব্যাংক রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ৭৪টি প্রকল্পে ২৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ অনুমোদন করেছে। ব্যাংকটি তার নতুন পাঁচ বছরের ঋণ কৌশল অনুসারে ২০২২-২০২৬ সময়ের মধ্যে আরও ৩০ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করবে।
এনডিবির পাবলিক সেক্টর ডিপার্টমেন্টের প্রজেক্ট টিম লিডার হি তিয়ান আট সদস্যের এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন, যার মধ্যে রয়েছে পাবলিক সেক্টর বিশেষজ্ঞ ঝেংইউ ইয়াং এবং আবদুর কাদের।
ইআরডি ছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ, সেতু বিভাগ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন, এবং অন্যান্য বিভিন্ন সরকারী সংস্থা এনডিবি'র সাথে আলোচনায় অংশ নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এনডিবির সদস্য হলেও ঋণ প্রস্তাব জমা দিতে দীর্ঘ বিলম্বের কারণে এখনও তাদের কাছ থেকে ঋণ পায়নি। সদস্য হওয়ার পর এনডিবি ঋণের প্রস্তাব চেয়ে ইআরডির মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দেয়।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এসওএফআর হার বেশি থাকায় বাংলাদেশ বাজারভিত্তিক ঋণ কম নিচ্ছে। এ কারণে এনডিবি থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে সরকার।
বর্তমানে, বাংলাদেশ এআইআইবি থেকে বাজার ভিত্তিক সুদের হারে ১০০% ঋণ নিচ্ছে। প্রতি বছর এডিপি বাংলাদেশকে যে ঋণ দেয় তার অর্ধেকের বেশি বাজারভিত্তিক।
কর্তৃপক্ষ এখনও এনডিবি অর্থায়নের জন্য কোনো আইন চূড়ান্ত করেনি। এ বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা হলে ব্রিকস ব্যাংক-অর্থায়িত প্রকল্পগুলো কিছু পরিমাণে কর মওকুফের সুবিধা পাবে। আইনের খসড়াটি এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।