রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা কমানোর, মোবাইল হ্যান্ডসেটে ভ্যাট বসানোর পরিকল্পনা
২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতি হিসেবে সরকার রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা বা প্রণোদনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবার পর ডব্লিউটিও-র নিয়মানুসারে প্রণোদনা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
আগামী অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে নগদ সহায়তার হার ০.৫ শতাংশীয় পয়েন্ট থেকে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট পর্যন্ত কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এমন একজন সিনিয়র সচিব বলেন, 'ডব্লিউটিওর নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ধীরে ধীরে নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা হবে।'
তিনি বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে সহায়তা অব্যাহত রেখে মসৃণ উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য এই কৌশলগত পন্থা নেওয়া হয়েছে। গত তিন দশক ধরে নগদ সহায়তা পেয়ে উপকৃত হচ্ছে বিভিন্ন খাত।
সার্বিক নগদ সহায়তা কমানোর পরিকল্পনা হলেও, ম্যানমেইড ফাইবারসহ নতুন কয়েকটি খাত আগামী অর্থবছর থেকে প্রণোদনার আওতায় আসতে পারে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুবিধার্থে।
স্থানীয় শিল্পের মধ্যে যেসব শিল্পের সক্ষমতা বেড়েছে, তাদেরকে দেওয়া কর সুবিধা কমানোর অংশ হিসেবে মোবাইল হ্যান্ডসেটে উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। একইসঙ্গে মোবাইল ফোন সংযোজনে (অ্যাসেম্বলিং) ভ্যাটের হার বিদ্যমান ৩-৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫-১০ শতাংশকরা হতে পারে আসন্ন বাজেটে। এর অর্থ, মোবাইলফোন কেনার খরচ বাড়তে পারে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আগামী অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রণোদনার হার পুনঃনির্ধারণ নিয়ে ইঙ্গিত দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। তবে নতুন অর্থবছরে কোন খাত কী হারে নগদ প্রণোদনা পাবে, তা আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্কুলার আকারে ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রণোদনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হলেও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও সরকার ভিন্ন নামে রপ্তানিকারকদের সহায়তা দেবে।
ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ কীভাবে রপ্তানি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে, তা-ও পর্যালোচনা করে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
চলতি বাজেটে রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা বাবদ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার। রপ্তানির পরিমাণ বাড়লে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল পর্যন্ত এ খাতে ৬ হাজার ৬৯ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে।
রপ্তানি খাতের নগদ সহায়তার বড় অংশ পান দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান এলডিসি থেকে উত্তরণের আগপর্যন্ত প্রণোদনার হার বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানির বিপরীতে আর নগদ প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। তাই এখন থেকে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত সময়কালে প্রণোদনার হার আরও বাড়িয়ে তৈরি পোশাক শিল্প খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
দেশের রপ্তানি বাণিজ্য উৎসাহিত করতে সরকার প্রায় আড়াই দশক ধরে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দিয়ে আসছে। পর্যায়ক্রমে নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকা বড় হয়েছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে ৪৩ খাতের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে সরকার নগদ সহায়তা দিচ্ছে।
রপ্তানি আয়ের ওপর সর্বনিম্ন ১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে সরকার। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরেও সরকার নতুন করে ৪টি খাতের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। এ খাতে সরকার ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে। আর তৈরি পোশাক খাতের (নিট, ওভেন ও সোয়েটার) অন্তর্ভুক্ত সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবেও ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়।
নতুন পণ্য বা নতুন বাজার সম্প্রসারণেও ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য ৪ শতাংশের অতিরিক্ত ২ শতাংশ বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়া তৈরি পোশাক খাতে ১ শতাংশ বিশেষ নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে সরকার।
রপ্তানি প্রণোদনার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে আরও খাত
এদিকে মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ওই সভায় ম্যানমেইড ফাইবার বা নন-কটন পোশাক, সোডিয়াম সিলিকেট, ধানের কুড়া থেকে উৎপাদিত অপরিশোধিত তেল, টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার খাতে নগদ সহায়তা দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসব খাতে নগদ সহায়তা দেওয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সভায় এসব পণ্যে নগদ সহায়তা দেওয়ার যৌক্তিকতা পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড কমিশনকে। আগামী এক মাসের মধ্যে ট্যারিফ কমিশন এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জানান ওই কর্মকর্তা।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম। তিনি টিবিএসকে বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নন-কটন পোশাকে নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর পাশাপাশি আরও তিনটি খাতে নগদ সহায়তা দেওয়া যায় কি না, তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া সভায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ পোল্যান্ড ও সুইডেনে রপ্তানির বিপরীতে স্বাভাবিক প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি আরও ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়েও সম্মত হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়টিও ট্যারিফ কমিশন পর্যালোচনা করবে।
ফের বাড়তে পারে মোবাইলফোনের দাম
আগামী ১ জুন বাজেট পেশকালে অর্থ বিলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মোবাইল হ্যান্ডসেটের ওপর নতুন ভ্যাট বসানোর প্রস্তাবটি দিতে পারেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে
এর আগে ২০২২ সালে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি বা বাণিজ্য পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছিল। এর জেরে খুচরা পর্যায়ে মোবাইলের দাম বেড়ে যায়।
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন করে উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে আরোপ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়া মোবাইলফোনের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, যার ভার প্রকারান্তরে ক্রেতার উপর যাবে এবং বিক্রিও কমে যাবে। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে থাকা ভোক্তাকে বাড়তি ভ্যাটের এই চাপ নিতে হবে।
কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশিস মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের অংশীদার স্নেহাশিস বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'হ্যান্ডসেটের ভ্যাট বাড়লে এই ভার ভোক্তার উপর চাপানো হবে। এতে মোবাইল হ্যান্ডসেটের বিক্রিও কমে যেতে পারে, যা বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক হতে পারে।'
চলতি বছর দেশের মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য থাকলেও, গত অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ গত এপ্রিলেও মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ গত চার বছর ধরে স্থানীয় মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারক ও সংযোজনকারীদের দ্রুত বিকাশের জন্য কর সুবিধা দিয়ে আসছে। যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের কারখানায় প্রিন্ট করা সার্কিট বোর্ড, চার্জার, ব্যাটারি, হাউসিং ও কেসিংয়ের মতো যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছে, ২০১৯ সালের এক আদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদেরকে ভ্যাট ছাড় দিয়েছে।
এবার বাজেটের আগে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের প্রাক-বাজেট আলোচনায় হ্যান্ডসেটসহ আরও কিছু খাতকে দেওয়া ভ্যাট সুবিধা যে কমিয়ে দেওয়া হবে, তার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক চাপ থাকায় ইতিমধ্যে সক্ষমতা অর্জনকারী খাতগুলোর সুযোগ-সুবিধা কমানো উচিত।
এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে, যার শর্ত হিসেবে জিডিপিতে রাজস্বের অবদান আগামী অর্থবছরে ০.৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
২০১৫ সালের আগপর্যন্ত বাংলাদেশ মোবাইলফোনের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর ছিল। পরে কিছু উদ্যোক্তা দেশে হ্যান্ডসেট সংযোজন শুরু করে। ২০১৯ ও ২০১৯ সালে এ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ আসে।
দেশে বর্তমান স্যামসাং, অপ্পো, ভিভো, টেকনো, সিম্ফনি, ওয়ালটন, লাভা, শাওমি, নোকিয়া ও রিয়েলমিসহ ১৪টি ফোনের কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ওয়ালটন উৎপাদন করছে, বাকিরা সংযোজন করছে।
স্থানীয় মোবাইল হ্যান্ডসেটে বর্তমানে সবমিলিয়ে কর ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ। আর আমদানিকৃত মোবাইলফোনের ক্ষেত্রে তা ৫৭ শতাংশ।
স্থানীয় কোম্পানিগুলো চাহিদার ৯৭ শতাংশই জোগান দিচ্ছে বলে টিবিএসকে জানান ফেয়ার গ্রুপের চিফ মার্কেটিং অফিসার মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন, যারা মূলত স্যামসাং ফোন উৎপাদন করে।
তিনি বলেন, 'গত বছর বাণিজ্য পর্যায়ে ভ্যাট আরোপের পর সেট বিক্রি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। নতুন করে ভ্যাট আরোপ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে। তাতে দাম বাড়লে বিক্রি আরও কমে যেতে পারে।'
২০২১-২২ সালে সালে এ খাতে অনেক বিনিয়োগ এসেছে উল্লেখ করে মেসবাহ উদ্দিন বলেন, নতুন করে ভ্যাট আরোপ করলে এসব বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।
তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়েছে (স্মার্ট ও ফিচারফোন সেটসহ) প্রায় ৩.৫ কোটি। ভ্যাট বাড়ালে চলতি বছর সেটি ২ কোটিতে নেমে আসতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে ১৫ হাজার কোটি টাকার স্মার্টফোনের বাজার রয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।