৩২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম এলসি খোলা হয়েছে এপ্রিলে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বিধিনিষেধ ও ডলার সংকটের কারণে গত এপ্রিলে আগের ৩২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম এলসি (ইম্পোর্ট লেটার অব ক্রেডিট) খোলা হয়েছে।
এছাড়া ডলার সংকটসহ গত কয়েকমাসে এলসি খোলা কমে যাওয়ায় এপ্রিলে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে গত ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে মাত্র ৪.৩০ বিলিয়নের আমদানি এলসি খোলা হয়। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ৪৯% কম।
এরচেয়ে কম এলসি খোলা হয়েছিল ২০২০ সালের আগস্টে। করোনার কারণে দেশের অর্থনীতিতে তখন কিছুটা স্থবিরতা থাকায় ৩.৭০ বিলিয়নের এলসি খোলা হয় সেসময়।
এছাড়া গত এপ্রিলে আমদানি এলসি সেটেলমেন্ট করা হয়েছে ৪.৬৯ বিলিয়নের। এরচেয়ে কম পেমেন্ট করা হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই মাসে। সে মাসে ৪.৬৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি পেমেন্ট করা হয়।
এলসি কম খোলার কারণ জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও ইমরানুল হক বলেন, "প্রথমত এপ্রিলে ঈদ উপলক্ষে ব্যাংকের কার্যদিবস অন্য মাসের তুলনায় কম ছিল। গত মাসে এলসি ওপেনিং কম হওয়ার এটি একটি কারণ। এছাড়া বর্তমানে ব্যাংক চ্যানেলে ডলারের সংকট আছে, তাই ব্যাংকগুলো এলসি খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক। এসব কারণেই এলসি খোলা কমেছে।"
বর্তমানে ব্যাংক চ্যানেলে ডলার সংকটের কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমাদের রপ্তানি আয় কমার ধারায় আছে। এছাড়া এপ্রিলে ঈদের মাস হওয়া সত্ত্বেও রেমিট্যান্স আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কম এসেছে। ফলে ব্যাংক চ্যানেলে এখন চাহিদামতো আমদানি এলসি খোলার মতো ডলার নেই।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, এলসি মার্জিন রাখাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব শর্ত মানলেও ব্যাংকগুলো চাহিদামতো এলসি খুলছে না। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে এলসি খোলার জন্য। এসব কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মোট ৫৬.৩৬ বিলিয়নের এলসি খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ পরিমাণ প্রায় ২৭% কম। সেইসঙ্গে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এলসি সেটেলমেন্ট করা হয়েছে ৬২.৪০ বিলিয়নের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮% কম।
ইমপোর্ট এলসি কম খোলার কারণে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব পড়ে উল্লেখ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়ালের আমদানি কম হলে দেশের উৎপাদনখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারলে বাকি খাতগুলো যেমন: পরিবহন, বিপনন থেকে শুরু করে কনজিউমার লেভেল পর্যন্ত এর প্রভাব পড়ে।"
"এছাড়া সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে। কারণ, ইমপোর্ট ডিউটি, ট্যাক্স, ভ্যাট থেকে সরকারের আয় কমে যায়। সেইসঙ্গে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। সবকিছু মিলে আবার ইনফ্লেশনকে ট্রিগার করে, যেটি পণ্যের সাপ্লাই কমে যাওয়ার কারণে হয়। এই ইনফ্লেশন কিন্ত বাইরে থেকে আমদানি করা নয়, নিজেদেরই তৈরি করা," বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এপ্রিলে ৫৭% কমেছে টেক্সটাইল ও লেদার মেশিনারিজের মতো ক্যাপিটাল মেশিনারিজের এলসি খোলার পরিমাণ।
এছাড়া কম্পিউটার বা মোটরসাইকেলের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারির এলসি খোলা কমেছে ৪৬%। টেক্সটাইল ফেব্রিক ও কেমিক্যালের মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়ালের এলসি খোলা কমেছে ৩২%। সিমেন্ট, স্ক্র্যাপ ভেসেলের মতো ইন্ডারমিডিয়েট পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৩১%, চাল ও গমের মতো ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১৮%।
এ প্রেক্ষিতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিতে পারে জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, "প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বীকার করে নিতে হবে এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া, মাল্টিপল এক্সচেঞ্জ রেট করাসহ যে পদক্ষেপগুলো ডলার সংকট কাটানোর জন্য নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি।
"এসব সিদ্ধান্তের কারণে রেমিট্যান্স ও এক্সপোর্ট প্রসিড কমে গেছে। বিশেষ করে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটকে বাজারের হাতে ছেড়ে না দিলে সামনে সংকট আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে," বলেন তিনি।