মোড়কজাত পণ্য সরবরাহে কর নীতি জটিলতায় বিপাকে এসএমই উদ্যোক্তারা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদিত মোড়কজাত পণ্য বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য হিসেবে সরবরাহ করে থাকেন। এ সরবরাহ পর্যায়ে ৭% অগ্রিম আয়কর কাটা হয়। কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই তাদের মোড়কজাত পণ্য উৎপাদন করলে এ কর নেই। ফলে তারা এসএমই উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে না কিনে নিজেরা উৎপাদন করছে।
এসএমই উদ্যোক্তারা বলছেন, এতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। এজন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এসএমই উদ্যোক্তারা পণ্য সরবরাহে ৭% অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার চান।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য বলতে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ চক্রের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোনো পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিও প্লাস্টিক খাতের বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি)-য়ে পণ্য বিক্রয়ে ৭% অগ্রিম আয়কর (টিডিএস) কর্তন থেকে অব্যাহতি চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে বলেছে, প্লাস্টিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান মোড়কজাত পণ্য উৎপাদন করে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে থাকে। এখন ৭% টিডিএস থাকায় বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজেরাই তাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য তৈরী করে উৎপাদন শুরু করছে। কেননা নিজের পণ্য নিজে বানালে টিডিএস আরোপিত হয় না। টিডিএস আরোপিত না হওয়ায় পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রেও খরচ সাশ্রয় করতে পারেন তারা। এর ফলে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও এই অব্যাহতির সুবিধা নিতে ক্রমশ নিজেরাই এ ধরনের পণ্য উৎপাদনের কারখনা তৈরীতে ঝুঁকে পড়ছে। এই বাস্তবতা আমাদের এসএমই খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত।
এদিকে এসএমই ফাউন্ডেশন তার বাজেট প্রস্তাবনায় বলছে, কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ওপর অগ্রিম আয়কর কর্তন ৭% হওয়াতে শিল্পায়নের সূতিকাগার কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে দ্রুত শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, "এসএমই উদ্যোক্তারা যে পণ্য তৈরী করে তা যদি বড় শিল্প উদ্যেক্তারা উৎপাদন শুরু করে তাহলে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারবে না। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ এ সমস্ত ছোট পণ্য তৈরী এসএমই উদ্যেক্তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া। প্রয়োজনে তারা সেটা মনিটরিং করতে পারে।"
এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের কারখানায় তৈরী হয় রং রাখার ছোট-বড় প্লাস্টিকের ক্যান, আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যের কৌটা ও বিভিন্ন আকারের টিনের কৌটা।
এর গ্রাহকের তালিকায় রয়েছে পেইন্টসে বার্জার, এশিয়ান, নিপ্পন, ডিলাক্স, এলিট এবং আইসক্রিমে স্যাভয়, পোলার, কোয়ালিটি ও লাভেলো, ফার্মাসিউটিক্যালসে রেডিয়েন্ট, পপুলার, এসিআই ফার্মা এবং ডেইরি খাতে আড়ং আর মিল্ক ভিটা।
এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির বলেন, "আমাদের উৎপাদিত পণ্য প্রাথমিক মোড়ক। আমরা আমাদের উৎপাদিত মোড়ক জাতীয় পণ্য ভোক্তা সাধারণের কাছে বিক্রয় করি না। এগুলো বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে বিক্রয় করি। আমরা যখন আমাদের পণ্য, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রয় করে থাকি, তখন আমাদের এই বিক্রয়মূল্যের উপর ৭% অগ্রিম আয়কর (টিডিএস) কাটা হয়।"
"আমাদের মতো এসএমই সেক্টরের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ৭% অগ্রিম আয়কর (টিডিএস) কর্তনের বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদের থেকে পণ্য ক্রয় করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এর পরিবর্তে তারা উক্ত পণ্যসমূহ নিজেরাই উৎপাদন শুরু করেছে। এর ফলে তারা যেমন ৭% (টিডিএস) দেয়া থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে তেমনি তারা, এই কর অব্যাহতির মধ্য দিয়েই মোড়ক পণ্যের দামও সাশ্রয়ী করে তুলছে।"
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বার্জার, প্যারাসুট, রূঁপচাদা নিজেরাই মোড়ক পণ্য উৎপাদন করছে। তাই এসএমই উদ্যোক্তাদের সুরক্ষায় উৎপাদনকারীদের ক্ষেত্রে বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি)-তে পণ্য বিক্রয় পর্যায়ে ৭% অগ্রিম আয়কর কর্তন থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রয়োজন।
এদিকে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনায় এসএমই শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য প্রিন্টিং শিল্প, প্যাকেজিং ও বাইন্ডিং এর সরবরাহকারীদের উৎসে আয়কর এর আওতা বহির্ভূত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে এনবিআরের কাছে।
ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ সংগঠন বলেছে, প্রিন্টিং, প্যাকেজিং ও বাইন্ডিং এর ক্ষেত্রে ৩%-৭% হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি থেকে না কিনে নিজেরাই ঐ শিল্প গড়ে তুলছে।