উদ্বোধনের আগেই ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর সম্মুখীন সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প
উদ্বোধন হওয়ার নির্ধারিত সময়ের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে – আমদানিকৃত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল দ্রুত, নিরাপদ, সাশ্রয়ীভাবে আনলোড করে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের পরিশোধন সক্ষমতা বৃদ্ধির – ডাবল লাইন সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপনের ব্যয় ও মেয়াদ চতুর্থবারের মতো বাড়তে চলেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কারিগরি নকশায় পরিবর্তন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন নির্মাণ কাজ যুক্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে দেশের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এই অবকাঠামো প্রকল্পের মেয়াদ আবারো বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।
চতুর্থ সংশোধিত প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৮,২২২ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪,৯৩৬ কোটি টাকা। এর আগে তৃতীয় সংশোধনে প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ৭,১২৫ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রস্তাবে তা বাস্তবায়নের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে।
জুলায়ে ডাবল লাইন সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উদ্বোধনের কথা থাকলেও, প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার পর চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০১৫ সালে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর পর তিন বার মেয়াদ বাড়ানো হয়। ইতোমধ্যে চতুর্থ সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. শরীফ হাসনাত।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান বলেন, "প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়লেও উদ্বোধন জুলাইয়ে হয়ে যাবে। উদ্বোধনের পর ছোটখাটো কিছু কাজ করতে হয়। তার জন্য প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।"
তিনি জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগে প্রবেশের অপেক্ষায় দেশ। গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) ও ডাবল পাইপলাইনের স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে গত মাসে। এখন চলছে প্রি- কমিশনিং পর্যায়।
আগামী মাসেই শুরু হতে যাচ্ছে প্রকল্পের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ফার্স্ট ফিলিং। এ লক্ষ্যে সৌদি আরব থেকে আনা হচ্ছে ১ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল। সবকিছু ঠিক থাকলে জুলাইয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমানে লাইটার জাহাজ থেকে এক লাখ টন তেল খালাসে ১০-১১ দিন লেগে যায়। পাইপলাইন চালু হলে তাতে দুই-তিন দিন লাগবে। তখন লাইটার জাহাজের প্রয়োজন হবে না। সাশ্রয় হবে পরিবহন খরচ।
এভাবে প্রকল্পটি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা পরিবহন খরচ সাশ্রয় করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও চীনের সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) ভিত্তিতে প্রকল্পতি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রস্তাবিত ডিপিপি অনুসারে, প্রকল্পের ঠিকাদার চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিইসি)-ইপিসি বিভিন্ন নির্মাণ কাজ যুক্ত করায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে। নতুন কাজগুলোর জন্য অতিরিক্ত ৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ৩৭৫.২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
জার্মানির আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স প্রকল্পটির ইপিসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
এছাড়া, নকশার পরিবর্তন, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট, কাস্টমস শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং বিভিন্ন ফি বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে বলে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে উল্রেখ করা হয়েছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) পরিশোধন সক্ষমতা বাড়বে ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে দেশের ক্রুড অয়েল পরিশোধন সক্ষমতা বছরে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টনে উন্নীত হবে।
পরিশোধনাগারটি বর্তমানে দেশের ২০ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা পূরণ করে, বাকি ৮০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়।
এছাড়া, জরুরি কোনো কারণে ইস্টার্ন রিফাইনারি বন্ধ থাকলে, বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে মহেশখালীতে তেল মজুদের জন্য স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে দুই মাসের জ্বালানি তেল মজুতের সক্ষমতা আছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মজুত সক্ষমতা বেড়ে আড়াই মাসের হবে। ফলে আকস্মিকভাবে সরবরাহ ব্যাহত হওয়া মোকাবিলায় জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার প্রস্তুতি ও অদম্যতা আরো বাড়বে।
জ্বালানি তেল যেভাবে গভীর সমুদ্র থেকে যেভাবে চট্টগ্রামে আসবে
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান টিবিএস'কে বলেন, মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম পাশে স্থাপিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বয়াতে এসে ভিড়বে তেলবাহী মাদার ট্যাংকারগুলো। জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল ও ফিনিস প্রোডাক্ট পাম্প করা হবে, যা সরাসরি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বয়া হয়ে দুইটি পৃথক পাইপ লাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে। সেখান থেকে পাম্পিংয়ের মাধ্যমে আসবে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে।
প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. শরীফ হাসনাত বলেন, "বর্তমানে ৭০ জন জার্মান ও চীনা প্রকৌশলীর নির্দেশনায় দুই শতাধিক শ্রমিক শেষ পর্যায়ের কাজে ব্যস্ত। প্রকল্প এলাকায় নিজস্ব বিদ্যুৎব্যবস্থার জন্য ৪ দশমিক ৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার চারটি জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে। অগ্নি-নিরাপত্তার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট।"
এছাড়া আবাসনের জন্য দুই ও তিনতলা-বিশিষ্ট ১৮টি ভবন, নিরাপত্তার জন্য ১৩টি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। যোগাযোগের জন্য দেড় কিলোমিটার চার লেনের সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।