অর্থনীতির সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি টাকার দুর্বল মান
ডলারের বিপরীতে টাকার মান আর এক টাকা কমলে আগামী অর্থবছর শুধু বিদ্যুৎখাতেই সরকারের ভর্তুকি বাবদ ব্যয় ৪৭৩.৬ কোটি টাকা বেড়ে যাবে। শুধু ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১০ শতাংশ কমলেই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩,৮০০ কোটি টাকা বেড়ে যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে।
এসব উদাহরণ তুলে ধরে একটি নথিতে টাকার অবমূল্যায়নকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মধ্যমেয়াদে (আগামী ৩ বছর) সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। কারণ, এটি মূল্যস্ফীতি উস্কে দিয়ে শুধু জনগণকেই ভোগাচ্ছে না, টাকার অবমূল্যায়নে আরো আর্থিক চাপ বাড়ছে সরকারেরও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ক্রমে দুর্বল হয়ে চলা টাকার মান – কীভাবে ভর্তুকিতে সরকারের সার্বিক ব্যয় বাড়াবে, ঋণ পরিশোধ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচের চাপ বাড়াবে।
'মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি ২০২৩-২৪ হতে ২০২৫-২৬' শিরোনামে প্রকাশিত বাজেট নথিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অন্যান্য কয়েকটি ঝুঁকিও চিহ্নিত করেছে।
টাকার সাম্প্রতিক অবমূল্যায়নে আমদানি ও নির্ধারিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
নথিতে বলা হয়, টাকার সাম্প্রতিক অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি ব্যয় ও নির্ধারিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিময় হারে আরো অবচিতি ঘটলে সরকারের ঋণ আরও বাড়তে পারে। মুদ্রার বিনিময় হারে অবচিতির কারণে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পও আর্থিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
"'টাকার অবমূল্যায়নের ফলে সরকারি প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়তে পারে। অনেক সরকারি প্রকল্প, বিশেষ করে মেগাপ্রকল্প আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এভাবে বিনিময় হারের অবচিতির ফলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করতে পারে।"
টাকার অবমূল্যায়ন যে সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে সরাসরি প্রভাব ফেলবে, এবং ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয়ও কমবে- সেবিষয়েও ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, "টাকার বিনিময় হারের পতন অব্যাহত থাকলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বছরভিত্তিক গড় মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) পরিকল্পনা অর্জন সম্ভব হবে না।"
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনেকটা নিজেদের অবস্থান মূল্যায়নেরই প্রচেষ্টা এই নথি। এতে টাকার অবমূল্যায়নে আমদানির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে সার্বিকভাবে আমদানি কমে যাওয়া এবং তার ফলে এখাত থেকে রাজস্ব হারানোর বিষয়েও বিশদভাবে বলা হয়। তাই মুদ্রার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকলে আমদানিখাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় আরও কমা এবং ভর্তুকিতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নথিটি জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশকে খাদ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪০,২৬৫ কোটি টাকা করতে হয়েছিল। টাকার আরও অবমূল্যায়নের কারণে সংশোধিত বাজেটে এসবখাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৫০,৯২৬ কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই কয়েকটিখাতে ভর্তুকি বাবদ ৬৬,৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে এক টাকার অবচিতির ফলে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির পরিমাণ ৪৭৩.৬ কোটি টাকা বেড়ে যাবে'- মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের একদল কর্মকর্তা নথিটি প্রস্তুত করেছেন। এতে আরো বলা হয়েছে, কর আদায় কম হওয়া ও বকেয়া কর, সরকারের উচ্চ সুদ ব্যয়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পুনঃমূলধনীকরণ এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দুর্বল ব্যালেন্স শিট এবং অনাদায়ী ঋণের জন্য সরকারের মূলধন যোগানের প্রয়োজন হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে যা সামগ্রিক আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা সীমিত করতে পারে। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির আগামী তিন বছরের ঝুঁকিগুলো তুলে ধরে এভাবেই সতর্ক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি চলতি অর্থবছরে ১৬তম বারের মতো তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির হার ১.৫ টাকা বাড়িয়েছে – ১ জুনের পর যা টাকার সবচেয়ে বড় একক অবমূল্যায়ন।
গত এক বছরে টাকা ২২.৬১ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে, যার ফলে ডলারের দাম ৮৬.৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১০৬ টাকা হয়েছে।
আইএমএফ- এর ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায়, নির্ধারিত পরিমাণ রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে টাকার মান আরো বাড়িয়ে ডলার সাশ্রয়ের চাপ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। এছাড়া, একক বিনিময় হার চালুর অঙ্গীকারও করা হয়েছে, যা আগামী মাস থেকে কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারি ঋণের ক্ষেত্রে বিনিময় হারের ওঠানামা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, আগামী অর্থবছর সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩৬,৪০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। পরের অর্থবছর এটি বেড়ে ৩৬,৬০০ কোটি টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছর ৩৭,১০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে।
ডলারের বিপরীতে টাকার ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হলে আগামী অর্থবছর শেষে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪০,২০০ কোটি টাকা। একইভাবে পরের অর্থবছরগুলোতেও ঋণের পরিমাণ বাড়বে।
নথিতে আরো বলা হয়, 'পিপিপি প্রকল্পগুলোর প্রত্যক্ষ খরচ এবং সুস্পষ্ট ও অন্তর্নিহিত প্রচ্ছন্ন দায় সরকারের জন্য আর্থিক ঝুঁকির জন্ম দিতে পারে। এটি উন্নয়নখাতে সরকারের অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ টিবিএসকে বলেন, 'বিনিময় হারের দ্রুত পতন বাংলাদেশের জন্য বিগেস্ট রিস্ক। বিনিময় হার শক্তিশালী নাহলে ফরেন লোনও কমে যাবে এবং বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হবে। আমদানিও ব্যয়বহুল হবে। ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়বে।'
তিনি আরো বলেন, 'দু'বছর আগে ডলার যখন শক্তিশালী হচ্ছিল, তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিলো ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো। কিন্তু, তখন তা করা হয়নি। এখন হঠাৎ করে ডলারের দাম ১০৭ টাকা বা তারও বেশি করা হলো– যার সঙ্গে অর্থনীতি খাপ খাইতে পারছে না।'
তিনি উল্লেখ করেন যে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ তাদের মুদ্রা পর্যায়ক্রমে অবমূল্যায়ন করেছে যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নরের মতে, 'গত দু'বছর ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সরকার বিনিময় হারকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করলেও এই রিস্ক মোকাবেলায় কোন অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে না।'
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, বিনিময় হার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় যে বিশ্লেষণ দিয়েছে, তা আংশিক। 'টাকার অবমূল্যায়ন হলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সরকারের টাকা ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি সরকার বিদেশ থেকে যে ঋণ পাবে, তার বিপরীতেও সরকার বাড়তি টাকা পাবে।'
'শুধু টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিখাত থেকে রাজস্ব বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে আমদানি থেকে রাজস্ব কমার কারণ হলো, ডলার সংকট। একারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃত্রিমভাবে চাহিদা কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে'- যোগ করেন তিনি।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, গত এক-দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ মুদ্রার বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে চেপে রেখেছিল। 'তারা ভেবেছিল, মূল্যস্ফীতি বাড়ার ভয়ে টাকার অবমূল্যায়ন না করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডলার সংকট দূর করবে। তাতে আমদানি কমেছে ঠিকই, কিন্তু ডলার সংকট আরও প্রকট হয়েছে, মূল্যস্ফীতিও বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছে গেছে।'
টাকার বিনিময় হার সংক্রান্ত আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ডলার যোগানের উপর গুরুত্বারোপ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ডলারের বিনিময় হারের উপর বিদ্যমান সীমা তুলে দিতে হবে। 'এছাড়া, মুদ্রানীতি, আর্থিক ও জ্বালানি খাতে সংস্কার আনতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্য জোরদার করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।'