ব্যবসায়ীরা আবারও করোনার সময়ে ফিরে যেতে চান: এফবিসিসিআই সভাপতি
ব্যবসায়ীরা আবারও করোনার সময়ে ফিরে যেতে চান উল্লেখ করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, গত ৪০ বছরে ব্যবসায়ীরা এমন সংকটে পড়েননি। করোনার সময় সবকিছু বন্ধ থাকলেও কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন সবকিছু খোলা সত্ত্বেও সংকট বড়। ব্যবসায়ীরা এখন করোনার সময়ে ফিরে যেতে যায়। কারণ ওই সময় অনেক সুবিধা ছিলো।
বুধবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, 'লুটের মালের মতো ব্যাংকগুলো যে যেমন পারছে ডলারের দাম আদায় করছে। বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের ১১৪-১১৫ টাকা দিতে হচ্ছে।'
'১৫ টাকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ২৫ টাকা করতে আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু শর্ত ছিল শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে হবে। সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা করেছে, কিন্তু আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছি না', বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, 'কলকাতা ও আগরতলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব খুব বেশি নয়। ওই দুই বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যমূল্য এতো বেশি হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু হচ্ছে।'
উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের বাজারে কোথাও কোনো সমস্যা আছে।'
'বাণিজ্যমন্ত্রী এক মাস আগে বললেন, দাম না কমলে ২-৩ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করবেন। তার ঘোষণার পর ব্যবসায়ীরা দাম কিছুটা কমিয়ে দুই-তিন দিন পর্যবেক্ষণ করলেন। কিন্তু সরকার পেঁয়াজ আমদানি শুরু না করায় তারা আবারও দাম বাড়াতে শুরু করে। এখন আমদানি শুরু হওয়ার পর দাম কমছে।'
'বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীকে সবসময় ট্রিগারে হাত রাখতে হবে। যাতে কেউ যখন অস্বাভাবিক কিছু করবে তখন গুলি ছোঁড়া যায়। বন্দুক হাতে আছে, কিন্তু গুলি করবো না- এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়,' বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নব্য ধনীদের চাকচিক্য থাকলেও অর্থনীতির গভীরতা তেমন নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি 'থিন অর্থনীতি'। অনেক কঠিন সময়ে এই বাজেট এসেছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬% এর মধ্যে রাখার লক্ষ্য বাস্তবসম্মত হয়নি। সরকার ভর্তুকি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। তবে কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি রাখা হবে।'
এম এ মান্নান বলেন, 'সরকার প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আমদানি বিকল্প শিল্পকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।'
বেসরকারি ট্যাক্স এজেন্ট সিস্টেম একসঙ্গে সারাদেশে চালু না করে প্রতিটি বিভাগীয় জেলা পর্যায়ে একটি উপজেলাতে পাইলটিং করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন আরও বলেন, 'সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা অংশীজন হলেও কী সংশোধন হচ্ছে তা আমরা জানি না।'
রপ্তানি বহুমুখীকরণ জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, নিজেদের কয়লা উত্তোলন বাড়ানোর প্রস্তাব করে তিনি বলেন, 'নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম দিতে রাজি হয়েছিল। সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'বাজেটে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আছে। কিন্তু কিভাবে সংগ্রহ হবে তার রূপরেখা নেই। তিনি কর ব্যবস্থা ডিজিটাল করার উপর জোর দেন।'
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার মত চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত হলেও কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানোর প্রস্তাব করে বলেন, এই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা না হলেও অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। বেসরকারি বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাও বাস্তবসম্মত নয়। কোনোভাবেই বাংলাদেশের বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৭.৪ শতাংশ হবে না।
দীর্ঘমেয়াদে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বাজেটের ভালো দিক হিসেবে উল্লেখ করে এম এ রাজ্জাক বলেন, সম্পদ কর আরোপ না করে অর্জিত সম্পত্তি থেকে যে আয় হয়, তার উপর করারোপ জরুরি। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ কমানোরও সুপারিশ করেন তিনি।
এমএ রাজ্জাক বলেন, নির্বাচনী বছরে সামাজিক নিরাপত্তায় সরকার জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমিয়েছে। বিশেষ করে খোলা বাজারে বিক্রি, ভিজিএফ, দরিদ্রদের কর্মসংস্থান খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। অন্যখাতে ব্যয় কমিয়ে এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা জরুরি। এজন্য কষ্টকর হলেও কিছু সমন্বয় করতে হবে। এখনই সমন্বয় উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তিনি ব্যাংক ঋণের সুদহার, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, উন্নয়ন বাজেটের সঙ্গে রাজস্ব বাজেটের সমন্বয় দরকার। দক্ষ জনবলের অভাবে প্রতিবছর ৬-৭ বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। তিনি বাজার ব্যবস্থাপনায় মনিটরিং জোরদার করার প্রস্তাব করেন।
বিল্ডের সিইও ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, 'ক্যাশলেস সোসাইটির জন্য ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ উন্নয়ন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো, এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, ব্যক্তি করদাতাদের ছাড় দেওয়া, সম্পূরক শুল্ক কমানোর মত ভালো উদ্যোগ রয়েছে বাজেটে।'
ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা।