চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ঋণ পুনঃতফসিল কমেছে ৮১%
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে দেশের ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণের ৩,৩৭৬ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৮১ শতাংশ কম।
২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছিল ১৭,৭৬৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে যে পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে এটিই স্বাভাবিক সময়ের চিত্র। যদিও গত ডিসেম্বরে পুনঃতফসিলের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল; এর অন্যতম কারণ হলো, আগের প্রান্তিকে বেশ কয়েকটি বড় গ্রাহকের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
এছাড়া, বছরের শেষে ব্যাংকগুলো ব্যলেন্স শিট পরিষ্কার রাখতে, খেলাপি ঋণ কমাতে পুনঃতফসিল বেশি করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ১৩,৭৪০ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। ঋণ পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতি এবং পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছু শিথিলতার কারণে এই পরিমাণ হ্রাস পায়।
চলতি ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিল করতে গিয়ে সুদ মওকুফ করেছে মাত্র ৫৮ কোটি টাকা। যদিও আগের ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফ ছিল ১,৮৯৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, গেল বছরের ডিসেম্বরে পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো, বড় কিছু ব্যবসায়ী এই সুবিধাটি নিয়েছে।
"গ্রাহকরা সুবিধাটি আরও আগে নিলেও পরিমাণটা দেখানো হয়েছে ওই ডিসেম্বর প্রান্তিকে, যার কারণে তখন এর পরিমাণ বেশি ছিল। তবে এখন পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফের যে পরিমাণটি দেখা যাচ্ছে, এটি স্বাভাবিক," যোগ করেন তিনি।
গত বছরের জুলাই মাসে, বাংলাদেশ ব্যাংক ২.৫ থেকে ৪.৫ শতাংশ আমানতের বিপরীতে নতুন ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি দিয়ে ব্যাংক বোর্ডগুলোর উদ্দেশ্যে নতুন সার্কুলার জারি করে। আগের নিয়ম বাদ দেওয়া হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাধারণত ব্যাংকিং সেক্টেরের দেখা যায়, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর প্রান্তিকে পুনঃতফসিলের পরিমাণ বাড়ে; কারণ ওই সময়ে বড় গ্রাহকদের দৌরাত্ম বেড়ে যায়।
"তারা ডিসেম্বরে এসে ঋণকে পুনঃতফসিল করতে পারলে খেলাপি গ্রাহকের তালিকা থেকে মুক্তি পায়, এরপর নতুন বছরে আবার ঋণ নিয়ে ছয়-নয় মাস দূরে থাকে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো ব্যালেন্স শিট স্বাভাবিক রাখতে বছরের শেষে খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাপক চেষ্টা করে। পুনঃতফসিল করে যদি কিছুটা খেলাপি ঋণ কমে, তাহলে ব্যলেন্স শিট কিছুটা ভালো দেখায়; এ কারণে ডিসেম্বরে পুনঃতফসিল করতে ব্যাংকগুলোরও তাগাদা থাকে।
মার্চ প্রান্তিক পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৩১,৬২০ কোটি টাকা, যা মোট আউটস্ট্যান্ডিং (বকেয়া) ঋণের ৮.৮ শতাংশ। এছাড়া, অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের কাছে পাওয়া ঋণ আটকে রয়েছে ১,৬৬,৮৮৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে অবলোপনকৃত (রিটেন-অফ) ঋণের পরিমাণ রয়েছে ৪৬,৭১৯ কোটি টাকা।
এদিকে, ব্যাংক ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য কর্মক্ষমতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। চলতি বছরের জুনের মধ্যে কার্যকর উপায়ে নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) রেজ্যুলিউশন স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নের নির্দেশনা দিয়েছে তারা।
২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে গড় এনপিএল অনুপাত ১০ শতাংশে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৫ শতাংশের নিচে কমিয়ে আনতে আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ঋণের ক্রমবর্ধমান পুনঃতফসিল এবং ঋণের সুদ মওকুফের ক্রমবর্ধমান ধারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর এক প্রান্তিকে পুনঃতফসিল বাড়ছে বা কমছে, এটি বড় বিষয় নয়। এখানে একজন গ্রাহককে যে পরিমাণ ছাড় দেওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেটি দেওয়া হচ্ছে; যার কারণে ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলো দিন দিন খারাপ অবস্থানে যাচ্ছে।
"একজন গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার আগে তার রিপেমেন্ট (ঋণ পরিশোধ) যোগ্যতা, কম্পিটেন্সসহ (সক্ষমতা) নানা দিক দেখতে হয়। ব্যাংকগুলো এগুলো না দেখেই যাকে ইচ্ছা ঋণ দিচ্ছে। আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে নীতি নির্ধারক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদিচ্ছা দেখছি না," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর মওকুফকৃত ঋণের সুদের পরিমাণ ২০১৮ সালের ১,১৯৪ কোটি টাকা থেকে পরবর্তী বছরে ২,২৯৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০২০ সালে এই পরিমাণ সামান্য হ্রাস পেয়ে ১,৫৭৮ কোটি টাকায় এবং এরপরে ২০২১ সালে আবার বেড়ে গিয়ে ১,৮৫৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
২০২২ সালে ব্যাংকগুলোর সুদ মওকুফের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫,০৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া, গত বছর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২৯,২৮৩ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের ১২,৩৮০ কোটি টাকার প্রায় দ্বিগুণ। ২০২০ সালে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩,৪৬৮ কোটি টাকা।