ঋণ ক্লাসিফিকেশন করার সময় কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, খেলাপি ঋণ বাড়ার শঙ্কা ব্যাংকারদের
ওভারডিউ ঋণকে ক্লাসিফাইড করার সময় অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উদ্যোগের ফলে ক্লাসিফাইড ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার জন্য তাদের গাইডলাইন অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি ঋণকে ক্লাসিফাইড হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ওভারডিউ পিরিয়ড ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করার পরিকল্পনা করছে। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও খেলাপি ঋণ কমাতে এ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আরও একটি বড় নির্দেশনা আসতে যাচ্ছে। সব ধরনের মেয়াদি ঋণ ওভারডিউ হওয়ার পর পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ক্লাসিফাইড করতে হবে, যা আইএমএফের বড় একটি শর্ত।'
অনেক ব্যাংকার এসব পদক্ষেপকে স্বাগত জালানেও, কেউ কেউ এসব উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী এমন পদক্ষেপ নিতে পারে—তবে এটি ক্লাসিফাইড ঋণের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেবে।
তিনি বলেন, 'দেশের সিংহভাগ ঋণই মেয়াদি ঋণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে তিন মাস পর ঋণ ক্লাসিফাইড করা হলে খেলাপি ঋণ ব্যাপক বেড়ে যাবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান নিয়ম অনুসারে, ছয় মাসের ওভারডিউ পিরিয়ডের পরে একটি মেয়াদি ঋণকে 'সাবস্ট্যান্ডার্ড' হিসেবে ক্লাসিফাইড (শ্রেণিভুক্ত) করা হয় এবং নয় মাস পর ঋণটিকে 'মন্দ/লোকসানি' হিসাবে ক্লাসিফাইড করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের যতই সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, তাদের দাবি আসতেই থাকে। এত ছাড় দেওয়ার পরও ঋণখেলাপি বাড়ছে।'
গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন রেখেছে। এ বিষয়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মেয়াদি ঋণ যদি তিন মাস ওভারডিউ থাকার পর ক্লাসিফাইড করা হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। তখন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ লুকানোর প্রবণতাও বাড়বে।'
এ উদ্বেগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারওয়ার হোসেন আশ্বস্ত করেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও জবাবদিহি বাড়াবে।
ঋণ জালিয়াতি কমাতে এবং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ কার্যকর করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসবের মধ্যে রয়েছে ওভারডিউ ও ক্লাসিফাইড ঋণের ওপর অতিরিক্ত দণ্ডসুদ, ঋণ গ্যারান্টরের আঙুলের ছাপ যাচাইকরণ বাধ্যতামূলক করা এবং ঋণ পরিশোধের জন্য সব ধরনের বিশেষ ছাড় তুলে নেওয়া।
লোন গ্যারান্টরদের আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করায় ঋণ জালিয়াতি অনেকাংশে কমে আসবে বলে উল্লেখ করেন সারওয়ার হোসেন।
তিনি আরও বলেন, যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার পরিকল্পনা করছে, তাদের জন্য ওভারডিউ ও ক্লাসিফাইড ঋণের ওপর আরোপিত দণ্ডসুদ সতর্কবার্তা হয়ে আসবে।
'এছাড়া দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণকে ক্লাসিফাই করার সময় সম্পর্কে আইএমএফের গাইডলাইনের ব্যাপারে আমরা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেব,' বলেন তিনি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'আগে আমরা তিন মাস ওভারডিউয়ের পরে ঋণ ক্লাসিফাইড করতাম। বড় ব্যবসায়ীদের অনুরোধে এ মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে আমাদের আন্তর্জাতিক চর্চার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।'
তিনি আরও বলে, 'আমাদের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করার আগে বিদেশি ব্যাংকগুলো সাধারণত আমাদের আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিসগুলোতে কোনো রকমের দুর্বলতা আছে কি না, তা যাচাই করে। তাই আমাদের ব্যাংকিং বিধিবিধানগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। তা না হলে আমাদের খেলাপি ঋণ বাড়বে।'
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।
মার্চ মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায়, যা মোট বকেয়া ঋণের ৮.৮০ শতাংশ।
লোন গ্যারান্টরের আঙুলের ছাপ যাচাইকরণ বাধ্যতামূলক
২ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করেছে। এতে বলা হয়, কোনো গ্রাহককে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণ গ্যারান্টরকে সশরীরে ব্যাংকে উপস্থিত থেকে আঙুলের ছাপ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে আদালতে বেশ কিছু রিট পিটিশন দায়ের করা হচ্ছে, যেখানে ঋণগ্রহীতা ও ঋণের গ্যারান্টররা ঋণ গ্রহণ ও জামিন প্রদান-সংক্রান্ত দলিলাদিতে স্বাক্ষর দেননি বলে দেখা গেছে। যার কারণে ঋণ আদায়ে আইনগত জটিলতা বন্ধে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও জালিয়াতি রোধে এই নির্দেশনা কর্যকরী ভূমিকা রাখবে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গ্যারান্টরের স্বাক্ষর নকল করে গ্রাহক ঋণ নিয়ে যায়। পরে ওই ঋণ খেলাপি হলে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে পেলেও গ্যারান্টর তার স্বাক্ষর নকল বলে জানান। এ ধরনের জালিয়াতি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে আরও বলা হয়, ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্য ও গৃহীত ডকুমেন্টের বিষয়ে ঋণগ্রহীতা ও গ্যারান্টরসহ সংশ্লিষ্ট তৃতীয় ব্যক্তি বা পক্ষকে ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরকে পড়ে শোনাতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে ঋণ গ্যারান্টররা তাদের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা সমন্বয় করার বিরুদ্ধে ১৩ হাজার ৬৪১টি রিট দায়ের করেছেন। এসব রিটের মধ্যে ৮০ শতাংশ আদেশ গেছে রিটকারীদের পক্ষে। দায়ের হওয়া রিটগুলোর সঙ্গে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ জড়িত।
ঋণ পরিশোধে কোনো বিশেষ ছাড় থাকছে না
কোভিডের কারণে ২০২০ সালে দেশের ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ২০২১ সালে ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে তারা খেলাপি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
২০২২ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ঋণ পরিশোধের এই বিশেষ ছাড় তুলে নিলেও এ সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা কার্যক্রমের অস্বাভাবিক ক্ষতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ পরিশোধের ছাড়ের আবেদন জানান।
ব্যবসায়ীদের ওই দাবির পরিপেক্ষিতে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প ঋণ, কৃষি ঋণ ও সিএমএসএমই ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এই সুবিধা তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র ৩ মাসের জন্য সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারে।
ফের ব্যবসায়ীদের একই দাবির পরিপেক্ষিতে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সব চলতি মূলধন ও মেয়াদি ঋণের ৫০ শতাংশ ঋণ পরিশোধে খেলাপি হবে না বলে বিশেষ ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও চলতি বছরের জুলাই থেকে এ সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঋণ পরিশোধে কোনো বিশেষ সুবিধা নেই।
ঋণ ওভারডিউ ও ক্লাসিফাইড হলেই ফের দণ্ডসুদ
গত ২৭ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নতুন নিয়ম চালু করে। এ নিয়মানুসারে, ব্যাংকগুলো ওভারডিউ ও ক্লাসিফাইড ঋণের ওপর সর্বোচ্চ ১.৫ শতাংশ দণ্ডসুদ নিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভালো ঋণগ্রহীতাদের উৎসাহিত করতে এবং মন্দ বা ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের নিরুৎসাহিত করতে খেলাপি ঋণের ওপর ফের দণ্ডসুদ আরোপ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করেছে ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, যেকোনো ওভারডিউ ঋণ বা কিস্তির জন্য চলমান বা ডিমান্ড ঋণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বকেয়া ঋণের ওপর এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ওভারডিউ কিস্তির ওপর ১.৫ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ হবে।