পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নতুন ৭ শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা
পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বড় আকারের ৭টি শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। আগামী তিন বছরে ধাপে ধাপে পার্কগুলো প্রতিষ্ঠা করা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে ফরিদপুর, যশোর, মাদারীপুর, নড়াইল, মাগুরা, শরীয়তপুর এবং পিরোজপুরে ২,০০০ একর জমিতে শিল্প পার্কগুলো নির্মাণের জন্য সরকারি তহবিল থেকে ৮,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে কর্পোরেশন। এসব স্থাপনায় অন্তত ১৪ থেকে ১৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বিসিকের তথ্যমতে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, খাদ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বস্ত্র, বনজ, পাট ও পাটজাত পণ্য, কাচ ও সিরামিক, কাগজ, প্রিন্টিং ও বোর্ড, ট্যানারি, চামড়া, রাবার, রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্প এবং অটোমোবাইল শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে।
বর্তমানে পদ্মা সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলায় বিসিকের অধীনে ছোট আকারের ২১টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট রয়েছে। এই এস্টেটগুলো সর্বনিম্ন ১০ একর থেকে সর্বোচ্চ ৫০ একর জমির ওপর নির্মিত।
বিসিকের চেয়ারম্যান মোঃ মাহবুবর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মূলত, পদ্মাসেতুকে ঘিরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে উন্নতি সাধিত হয়েছে, সেটির সুফল পেতেই এসব শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। প্রস্তাবিত শিল্পনগরী গড়ে তুলতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে।"
তিনি বলেন, "সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় পদ্মা সেতুর ওপারে (দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে) তেমন শিল্প গড়ে উঠেনি। এখন যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় নতুন শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উদ্যোক্তারাও নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন।"
বিসিক সাধারণত উদ্যোক্তাদের কারখানা ও শিল্প স্থাপনের সুবিধার্থে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট বা শিল্পনগরী তৈরি করে থাকে। জমি অধিগ্রহণের পর এই কর্পোরেশন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও রাস্তাসহ অবকাঠামোগত সুবিধার উন্নয়ন করে এবং কারখানা স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের প্লট বরাদ্দ দেয়।
বিসিকের ২০২১-২২ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে ২,১৯৪ একর জমিতে ৮০টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট পরিচালনা করছে বিসিক। এসব জায়গায় ৮ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তবে এখন বিসিকের বিরুদ্ধেও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ উঠেছে যে, কর্পোরেশন তাদের কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না।
এদিকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এত বড় নতুন পরিকল্পনার বিষয়ে বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, "যে টাকা ব্যয় হবে, সব তো একসঙ্গে লাগবে না। প্রতি বছর ধাপে ধাপে সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নেওয়া হবে। কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে।"
"গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটটা সাময়িক; এখন রয়েছে, কিছুদিন পরে সংকট থাকবে না। শিল্পায়ন করতে হলে গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাগবেই। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে, আর আমরাও সেই বিবেচনায় নতুন শিল্পস্থাপনে নতুন পরিকল্পনা করেছি," জানান তিনি।
৬ শিল্পনগরীর জমি অধিগ্রহণের সম্মতি পেয়েছে বিসিক
বিসিক কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুকে ঘিরে টেকসই শিল্পায়নে একটি বিশেষ কর্মসূচির অধীনে প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণে ৬টি জেলার প্রশাসনের সম্মতি মিলেছে। এ পর্যায়ে সেখানে ড্রইং, ডিজাইনসহ প্রাক্কলনের কাজ চলছে।
শরীয়তপুরের জাজিরায় শিল্পপার্ক স্থাপনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে ৩০০ একর জায়গা চেয়েছে বিসিক। জমি পাওয়া সাপেক্ষে শিল্পপার্ক স্থাপন কার্যক্রম গ্রহণ করবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নে সম্পৃক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। এই শিল্পপার্ক বাস্তবায়িত হলে ১.৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
অটোমোবাইল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের অন্যতম হাব (কেন্দ্র) হলো যশোর। তাই যশোরেই ফাউন্ড্রি, অটোমোবাইল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পপার্ক গড়ে তুলবে বিসিক।
৪১০ এক জায়গা এই শিল্পনগরী স্থাপনে জেলা প্রশাসক থেকে জমি প্রাপ্তির সম্মতিপত্র গ্রহণ করেছে কর্পোরেশন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
মাদারীপুরের শিবচরে ৩৫০ একর জায়গার ওপর মাল্টিসেক্টরাল শিল্পপার্ক স্থাপন করবে বিসিক। নতুন স্থাপনার মাধ্যমে এই শিল্পপার্কে ১.৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া, ফরিদপুরের নগরকান্দায় ৫০০ একর, নড়াইলে ৩৫০ একর, মাগুরায় ১৯৩.৬ একর, পিরোজপুরে ৩০৯.৭৩ একর জায়গায় শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বিসিকের।
তবে এসব শিল্পপার্কের বৈশিষ্ট্য কী হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। মূলত, উদ্যোক্তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই শিল্পপার্কের ধরণ নির্ধারণ করবে বিসিক।
১৯৫৭ সালে সূচনার পর থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে মূখ্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।
বিসিকের তথ্যানুযায়ী, ৮০টি শিল্পনগরীতে ১১,৯২২টি শিল্পপ্লট প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ৫,৯৪৯টি শিল্প ইউনিট স্থাপিত হযেছে। শিল্প ইউনিটসমূহে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ৪৩,২৫৯ কোটি টাকা; আর এই ইউনিটগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য ৭৬,৪১০ কোটি টাকা।
শিল্পনগরীতে রপ্তানিমুখী শিল্প রয়েছে ৯৬২টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই শিল্প ইউনিট ৪৬,২৯৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে।