বিদেশি ঋণের সুদের ওপর ২০% করারোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক
চলতি বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পেমেন্টের ওপর ২০ শতাংশ 'উইথহোল্ডিং ট্যাক্স' আরোপ করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনবিআরকে বলেছে, এই কর বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এর ফলে বিদেশি ঋণ নেওয়ার খরচ কার্যত এক-চতুর্থাংশ বেড়ে যাবে।
গত ৩১ আগস্ট পাঠানো একটি চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এনবিআর এর আগে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জারি করা একটি সার্কুলারের মাধ্যমে বিদেশি ঋণের সুদের ওপর কর মওকুফ করেছিল। তবে চলতি বছরের ২৩ মে একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়।
এর ফলে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট ও বায়ার্স ক্রেডিট দ্বারা পাওয়া বিদেশি ঋণের বিপরীতে সুদ পেমেন্টের ক্ষেত্রে এখন থেকে ২০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতারাই এই অতিরিক্ত খরচ বহন করবে, বিদেশি ঋণদাতারা নয়। ফলে গ্রস-আপ ভিত্তিতে হিসাব করা হলে, করের হার কার্যত ২৫ শতাংশ বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছে যে, বিদেশি ঋণের সুদের হার ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে এবং নতুন আরোপিত কর এই ঋণগুলোকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণের সুদহার এবং বিনিময় হারের ঝুঁকির কারণে অফশোর ব্যাংকিং ইউনি, কর্পোরেট ও আমদানিকারকরা বিদেশি ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হবে, যা টাকার তারল্য ও বিনিময় হারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের ফোরাম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বিদেশি ঋণের ওপর করারোপের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সতর্ক করার পর তারা চিঠিটি লিখেছেন।
শনিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে মেজবাউল বলেন, 'বিদেশি ঋণ নেওয়ায় সময় ব্যাংকগুলো যেসব অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছে, তা জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। আমরা এনবিআরকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে কর প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেছি।'
মেজবাউল আরও বলেন, বিদেশি ঋণের প্রবাহ কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে দেশের আর্থিক হিসাব ও চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ওপর। এই দুটোই ইতিমধ্যে ঋণাত্মক অবস্থায় আছে।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় একজন এনবিআর কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, এনবিআর বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিটি পর্যালোচনা করছে। বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর ২০ শতাংশ কর প্রত্যাহার বা কমানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে বলে জানান তিনি।
ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন কেন?
ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা বলছেন, প্রত্যাহার না করা হলে এই কর দেশের অভ্যন্তরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ অনেক উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য এই সাশ্রয়ী ঋণ নিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ দেশের অন্যতম প্রধান টেক্সটাইল এবং পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের কথাই ধরা যাক। গ্রুপটি বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য সরাসরি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিট।
ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও কে এম রেজাউল হাসানাত বলেন, 'দেশে ডলার না পাওয়ায় আমরা বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিই।'
তাদের আর মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ শোধ বাকি আছে। তাই তিনি এখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারেন। তবে রেজাউল আকস্মিক করারোপের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ব্যবসায়ীদের সমন্বয় করার জন্য কোনো সময় দেওয়া হয়নি।
রেজাউলের মতে, এ ধরনের অপ্রত্যাশিত কর ব্যবস্থার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলে। কারণ তারা সাধারণত তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য মূল কোম্পানি ও বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের ওপর নির্ভর করে।
গত এক দশকে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, সিরামিকস ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে ডিবিএল গ্রুপ। মূলত ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি), ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্টসহ অন্যান্যদের প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া কম খরচের বিদেশি ঋণের কারণে তাদের এই ব্যবসা সম্প্রসারণ সহজ হয়েছে।
গত বছর গ্রুপটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৯৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু করারোপের কারণে এখন থেকে এ ধরনের ঋণ নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগবে বলে জানিয়েছে তারা।
এই কর পদক্ষেপ যেভাবে ব্যয় বাড়ায়
আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার এখন আগের লাইবর বেঞ্চমার্কের বদলে সেকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর)-এর মাধ্যমে হিসাব করা হয়। বিদেশি ঋণে ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সুদের মার্জিন থাকে। সম্প্রতিক ইউএস ফেডারেল রিজার্ভের সুদহাহার বেড়েছে। তার সঙ্গে সোফর হার বেড়ে হয়েছে ৫.৩১ শতাংশ (৯ সেপ্টেম্বর)—মহামারিকালে এ হার ছিল মাত্র ০.২৫ শতাংশ। এর ফলে আন্তর্জাতিক ঋণের সুদহার গেছে বেড়ে।
যেমন, বায়ার্স ক্রেডিট বা অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে এক বছরের জন্য ২ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিলে তার সুদ আসে কমবেশি ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। নতুন উইথহোল্ডিং ট্যাক্স আরোপ করায় ঋণগ্রহীতাদের এখন প্রায় ৩৯ লাখ টাকা সুদ-সংক্রান্ত কর গুনতে হবে। এই কর বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপ করা হলেও, শেষ পর্যন্ত বিদেশি ঋণদাতারা তাদের সুদের ওপর ধার্য করের অংশটি ঋণগ্রহীতার ওপরই চাপিয়ে দেয়।
এই কর আরোপের আগে বাংলাদেশী ঋণগ্রহীতারা স্থানীয় ঋণের জন্য সর্বনিম্ন ৮ শতাংশের বিপরীতে আন্তর্জাতিক ঋণের জন্য সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ বা তার কম সুদহার পেত। এখন ডলার-অধ্যুষিত বিদেশি ঋণের সুদহার প্রায় ১১ শতাংশ—অন্যদিকে স্থানীয় ঋণের সুদহার ১০.১০ শতাংশ। অর্থাৎ বিদেশি ঋণ এখন স্থানীয় ঋণের চেয়ে ব্যয়বহুল।
ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন, এই করের ফলে ডলারে ঋণ নেওয়া বাধাগ্রস্ত হবে। এর ফলে ইতিমধ্যেই ২৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে যেতে পারে।