নতুন জিএসপি’তে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছেন, দেশটির নতুন জিএসপি কর্মসূচিতে বেশকিছু তৈরি পোশাক (আরএমজি) পণ্য অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তারা আরও বলেছেন, এতে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভূক্ত হলে এবং নির্ধারিত শর্তগুলো পূরণ করতে পারলে– শুল্কমুক্ত সুবিধায় আরএমজি পণ্য রপ্তানি করতে পারবে।
বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) সংক্রান্ত পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিরা একথা জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য নিবন্ধনের ফি কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের তুলায় তৈরি আরএমজি পণ্য রপ্তানিতে শুধু বাংলাদেশে মূল্য-সংযোজিত দামের উপর শুল্কারোপের প্রস্তাব বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে দেশটি।
বাণিজ্য সচিব জানান, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার, শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম হত্যা মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সুপারিশ অনুযায়ী, শ্রম আইন সংশোধন করার মত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কারখানায় শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধান আরো সহজ করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যে কোন কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে হলে অন্তত ২০ শতাংশ শ্রমিকের লিখিত সম্মতির প্রয়োজন হয়। এটি কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ করেছে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।
'ইউএসটিআর কর্মকর্তারা বলেছেন, নতুন জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশ দুইভাবে পেতে পারে। একটি হলো- জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য যেসব কমপ্লায়েন্সের শর্ত থাকবে, সেগুলো অর্জন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, সেভাবে হবে'- জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক (আরএমজি) পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয় বাংলাদেশকে।
এছাড়া, বর্তমানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাহিদার ১৪ শতাংশ তুলা আমদানি করছে।
এবিষয়ে ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, জিএসপির সংবেদনশীল তালিকায় নেই, এমন পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি উল্লেখ করেন, 'নতুন যে জিএসপি প্রোগ্রাম হবে, সেখানে কয়েকটি অপশন থাকবে। তারা চিন্তা করছে, কোন অপশন দিয়ে বাংলাদেশকে এ সুবিধার মধ্যে রাখা যায়।'
জিএসপি সুবিধা কার্যকরের কোনো তারিখ জানা যায়নি
কবে নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জিএসপি কর্মসূচি কার্যকর হবে– টিকফা বৈঠকে সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেননি মার্কিন কর্মকর্তারা।
টিকফা সভায় উপস্থিত থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ২০১৩ সালে স্থগিত হওয়া জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের প্রস্তাব করেনি বাংলাদেশ। তবে ২০০৫ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হংকং মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে 'শুল্ক মুক্ত, কোটা মুক্ত' সুবিধা চেয়েছে বাংলাদেশ।
জবাবে ইউএসটিআর কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি কর্মসূচির মেয়াদ ২০২০ সালে শেষ হয়েছে। তারা এখন নতুন কর্মসূচি চূড়ান্ত করছেন, যা এখন সিনেটে পর্যালোচনাধীন রয়েছে।
আশাবাদী ব্যবসায়ী নেতারা
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি বিকেএমইএ-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলা দিয়ে উৎপাদিত পোশাক পণ্য রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়– তাতে উভয় দেশই লাভবান হবে।'
'এটা আমাদের যুক্তিসঙ্গত দাবি, আশা করি যুক্তরাষ্ট্র তা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে'- যোগ করেন তিনি।
শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকারের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বিজেএমইএ-র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম-ও একই মতপোষণ করেন।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, 'ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইডিএফসি) ফান্ড এর তালিকায় বাংলাদেশের নামও যাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেটি বাংলাদেশ বলেছে। তবে তারা (ইউএসটিআর কর্মকর্তারা) বলেছেন, জিএসপি আর এই ফান্ড থেকে অর্থায়ন পাওয়ার শর্ত একই।'
হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে স্বল্পন্নোত দেশগুলোর (এলডিসি) ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র ওই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করেনি।
রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে বেশকিছু অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের শর্ত দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওইসব শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় দাবি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে আরও উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে এখনও চীনের শেয়ার অনেক বেশি।
উভয় দেশই জিএসপি থেকে লাভবান হবে
রাজ্জাক বলেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে আমদানি কমাতে চাচ্ছে। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে আমদানি বাড়ালেও চীনা ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবে। কারণ, ওই দুই দেশে চীনা বিনিয়োগ অনেক বেশি। এসব কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যে জিএসপি সুবিধা দিলে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ-উভয়ই লাভবান হবে।
'বাংলাদেশ তিন বছরের মধ্যে এলডিসি গ্রাজুয়েশন পাবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি শুধু এলডিসির জন্য হলে তাতে খুব বেশি সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। ইউরোপের জিএসপি প্লাস এর মতো যুক্তরাষ্ট্রও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জিএসপি স্কিম করলে– তাতে বাংলাদেশ অনেক বেশি লাভবান হবে'- বলছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য নিবন্ধন করতে অনেক সময় ও ফি লাগে উল্লেখ করে বাণিজ্য সচিব বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এই সময় ও ফি কমিয়ে আনার প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। 'কারণ আমাদের অনেক স্টেট অব দ্য আর্ট ফার্মাসিউটিক্যাল ফ্যাক্টরি আছে, রোবাস্ট ফার্মা সেক্টর রয়েছে।'
'প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় কমাতে চান, সেটাও আমরা তুলে ধরেছি'- জানান সচিব।
সভায় কোন কোন ক্ষেত্রে ফি ও সময় কমানো যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে লিখিত প্রস্তাব চেয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
ট্রিপস নিয়ে আলোচনা
বাংলাদেশের কপিরাইট আইন – প্যারিস কনভেশন ও ট্রিপস এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
এর বিরোধীতা করে বাংলাদেশ বলেছে, প্যারিস কনভেনশন ও ট্রিপসের সাক্ষরকারী বাংলাদেশ। ফলে ঢাকা কখনও এসবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন আইন করবে না। কপিরাইট আইনে এ ধরণের কোনকিছু চিহ্নিত হলে তা সংশোধন করা হবে।
বাংলাদেশ থেকে নকল পণ্য রপ্তানি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ কোন নকল পণ্য রপ্তানি করে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোন ব্র্যান্ডের পণ্য নকল হলে তারা বাংলাদেশকে অভিযোগ জানাতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
বাংলাদেশে ব্যবসারত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মুনাগা বা ঋণের কিস্তি প্রত্যাবাসনে সমস্যার সমাধান চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বলেছেন, একটি কোম্পানির সমস্যার তথ্য তাদের কাছে ছিল। তা সমাধানে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোন কোম্পানি একই সমস্যায় পড়লে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা।
যুক্তরাজ্য সম্প্রতি তাদের ডেভেলপিং কান্ট্রি ট্রেডিং স্কিম চালু করেছে। আগামী বছরের শুরুর দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের নতুন জিএসপি স্কিম চালু করবে।
নতুন এসব স্কিমে শ্রম অধিকার, শিশু শ্রম, মানবাধিকার ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা- সংক্রান্ত বিভিন্ন শর্ত রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, একক দেশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। গত অর্থবছরে দেশটিতে ৯.৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, এরমধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য সচিব বলেন, টিকফা সাক্ষরকালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। জিএসপি সুবিধা পেলে এটি বেড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে।