ডলার সংকটে জমছে বকেয়া প্রিমিয়াম, দেশের বাজার ছাড়ার সতর্কতা দিচ্ছে বৈশ্বিক পুনর্বিমাকারীরা
চলমান ডলার সংকটের কারণে প্রিমিয়াম বকেয়া থাকায় বৈশ্বিক পুনর্বিমাকারীরা বাংলাদেশের বাজার ছাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে কলকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য প্রধান প্রধান প্রকল্পসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্পত্তির ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন এ শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-র একটি নথি দেখেছে। নথি অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির পুনর্বিমার প্রিমিয়াম পাওনা ছিল ১ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।
ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার পরেও দেশের বিমা কোম্পানিগুলো ডলার সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে, এ অবস্থায় বকেয়ার এই অঙ্ক আরও বেড়েই চলেছে।
বিমা শিল্পের বিশেষজ্ঞদের হিসাবমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ বকেয়ার পরিমাণ বেড়ে দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, লন্ডন-ভিত্তিক বিমা মধ্যস্ততাকারী (ব্রোকার) টাইজার্স বাংলাদেশের বিমাসেবাদাতাদের প্রায় ৫০টি নোটিশ দিয়েছে। পুনর্বিমা কাভারেজ বাতিল হওয়া এড়াতে নোটিশে তাদের চার সপ্তাহের মধ্যে বকেয়া প্রিমিয়াম নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে।
টাইজার্সের কান্ট্রি ম্যানেজার এস এম মইনুল ইসলাম সতর্ক করে বলেন, 'এটা একটা অশুভ লক্ষণ। তারা (পুনর্বিমা দাতারা) যদি বাংলাদেশের বাজার থেকে চলে যায়, তাহলে মেগাপ্রকল্পসহ অনেক সম্পত্তি বিমাহীন হয়ে থাকবে।'
পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে, এই অবস্থায় (কর্তৃপক্ষের) তাৎক্ষণিক কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া, বৈশ্বিক পুনর্বিমা কোম্পানিগুলোর কাভারেজ হারানোসহ স্থানীয় বিমা শিল্প কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে'- বলছিলেন তিনি।
ডলার সংকটে টাইজার্সের বাংলাদেশ শাখা ২০০ কোটি টাকা পাঠাতে পারছে না, যা কয়েকমাস ধরে বকেয়া আছে। একইভাবে, বিভিন্ন দেশের পুনর্বিমা দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০০ কোটি টাকার বেশি পাঠাতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কর্পোরেশন।
গ্রিন ডেল্টা, পাইওনিয়ার, রিলায়েন্স, প্রগতি-সহ অন্যান্য বিমা কোম্পানিও একই সমস্যায় পড়েছে। এই সমস্যাকে নিজেদের ব্যবসার জন্য মারাত্নক ঝুঁকি বলছে তারা। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী বিমার গ্রাহক কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে, তাকে বা তার নমিনিকে তাদের দরকারি ক্ষতিপূরণ দিতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অথচ প্রিমিয়াম বকেয়া পড়ায় তারা পুনর্বিমাদাতাদের থেকে পর্যাপ্ত তহবিল পাচ্ছে না। যদিও এসব পুনর্বিমাদাতা কোম্পানি-ই ক্ষতিপূরণের ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ দিয়ে থাকে।
রিলায়েন্স ইন্সুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খালেদ মামুন বলেন, 'পুনর্বিমাকারীদের থেকে আমরা ক্যান্সেলেশন নোটিশ পাচ্ছি। তাদের বকেয়া প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে না পারলে, আরও নোটিশ দেবে।'
গ্রিন ডেল্টার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা চৌধুরী এবং প্রগতি ইন্সুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শিহাব উল্লাহ আল মঞ্জুর-ও একই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ক্ষতিকর এই প্রভাব শুধু বিমা কোম্পানিগুলোর ওপর নয়, বরং সার্বিক অর্থনীতিতেও পড়বে।
দেশের বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্বিমাকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলারে) তাদের প্রাপ্য প্রিমিয়াম পরিশোধ করে।
গত বছর থেকেই এসব পাওনা মেটানোর প্রক্রিয়া (ডলার রেমিট করা) মন্থর হয়ে পড়েছে বলে জানান গ্রিন ডেল্টার ফারজানা চৌধুরী। দেশের প্রস্তুতকারক খাত ও টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম প্রধান বিমাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রিন ডেল্টা।
সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ অর্থ পরিশোধে সমস্যার কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন যে, এই পদে নতুন এসেছেন, তাই পুনর্বিমা প্রিমিয়ামের ডলার পাঠাতে সমস্যার বিষয়ে পুরোপুরি জানেন না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তীব্র ডলার সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে তা বর্তমানে ২১ বিলিয়নে নেমে এসেছে।
পুনর্বিমা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
বিমা শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো পুনর্বিমার সুবিধা। এতে বিমা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ামের বিনিময়ে তাদের বিমাঝুঁকির একটি অংশ অন্যান্য বিমা প্রদানকারীর কাছে স্থানান্তরের সুযোগ পায়। এই পদ্ধতি ঝুঁকির বন্টনে সহায়তা করে এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষতির বিরুদ্ধে বিমাকারী প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেয়।
আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেসরকারি বিমা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ব্যবসার ৫০ শতাংশ সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের মাধ্যমে পুনর্বিমা করাতে হয়। বাকি অর্ধেক দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে পুনর্বিমা করানো হয়। তবে সব কোম্পানিই বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের সাথে যুক্ত নয়।
দেশের ৪৬টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানির মধ্যে, মাত্র ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসার বিপরীতে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ভারতের কোম্পানিগুলোয় পুনর্বিমা করিয়েছে। বাকিরা নির্ভর করে সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের ওপর, কিন্তু সাধারণ বিমাও তাদের ৯০ শতাংশ ঝুঁকি বিদেশি কোম্পানির সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
তাছাড়া, সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের সম্পত্তি পুনর্বিমা দেওয়ার সক্ষমতা সীমিত, বা মাত্র ৪০০ কোটি টাকা। ফলে ৪০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যায়নের সম্পত্তি যেমন– বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প কারখানার মতোন বড় প্রকল্পগুলোর জন্য স্থানীয় বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের দ্বারস্থ হতে হয়। এই পুনর্বিমা সুবিধা ধরে রাখতে তাদের নিয়মিতভাবে প্রিমিয়াম রেমিট্যান্স আকারে পাঠাতে হয়।
রিলায়েন্স ইন্সুরেন্সের খালেদ মামুন উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকা বিমা কাভারেজ দরকার হয়। বাংলাদেশের সব বিমা কোম্পানি মিলেও এর পুরোটা দিতে পারবে না। ফলে ৯৯ শতাংশ কাভারেজই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের থেকে নিতে হয়।
বাংলাদেশের বিমা ও পুনর্বিমার প্রিমিয়াম
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-র তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশের ৪৬টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানি ৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা প্রিমিয়াম বাবদ আয় করে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও সম্পত্তির একমাত্র বিমাদাতা হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের প্রিমিয়াম আয় ছিল ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
২০২২ সালে মোট প্রিমিয়ামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা এসেছে অগ্নিবিমা থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছে নৌবিমা থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি। তারপরেই বিবিধ বিমা থেকে ১ হাজার ১৭৩ কোটি এবং মোটরবিমা থেকে প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ২৬৭ কোটি টাকা।
বিবিধ ও মোটরবিমার জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে বিদেশি কোম্পানির কাছে পুনর্বিমা করাতে হয় না। কারণ এগুলোর ক্ষতিপূরণের পর্যাপ্ত সক্ষমতা তাদের রয়েছে। পুনর্বিমা মূলত দরকার হয় অগ্নি ও নৌবিমা পলিসিতে। বিশেষত, এসব পলিসির সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে ভাগাভাগি করে নিতেই তা করতে হয়।
আইডিআরএ-র তথ্য বলছে, ২০২২ সালে পুনর্বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করা হয়েছে ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ২০ কোটি ডলারের সমান) বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা ছিল। পুনর্বিমার বাকি টাকা দেশের বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো ও সাধারণ বিমা কর্পোরেশন পেয়েছে।