রাজনৈতিক অস্থিরতা: বিজিএমইএ আত্মবিশ্বাসী, তবে আরএমজির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত প্রস্তুতকারকেরা
জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এর মধ্যেই চলমান ডলার সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে অস্থিতিশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তবে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী নেতারা এই ঝড় মোকাবিলায় শিল্পের সক্ষমতার ওপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে কিছু পোশাক রপ্তানিকারক, ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউসের প্রতিনিধিরা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, চলমান অস্থিরতার প্রভাব পড়তে পারে এ শিল্পের ওপর।
অন্তত ১০ জন রপ্তানিকারক, ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউসের প্রতিনিধি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন যে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন না হলে পোশাক ব্যবসায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনিতেই সম্প্রতি ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের সহিংস আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে খাতটি।
তারা বলেন, মার্কিন সরকার যদি 'অগ্রহণযোগ্য' নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে কমপ্লায়েন্স উদ্বেগের কারণে বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং বন্ধ করে দিতে পারে। এতে তাদের ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর শ্রম অধিকার-সংক্রান্ত নতুন নীতি ঘোষণার পর এক বৈঠকে শীর্ষ রপ্তানিকারকদের একটি দলও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার কাছে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সোমবার (২৭ নভেম্বর) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের দেওয়া বক্তব্যেও তাদের উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটেছে। ওই বক্তব্যে সিইসি পোশাক ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এ খাতের ভবিষ্যৎ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর নির্ভর করতে পারে।
নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'আমাকে বাঁচাতে হলে, আমার জনগণকে বাঁচাতে হলে, আমার গার্মেন্টসকে বাঁচাতে হলে, আমার সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে হলে…বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার হতে হবে।
সিইসি আরও বলেন, 'আমাদের অর্থনীতি, আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে এ নির্বাচনকে ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল করতে হবে।'
'ব্যবসার জন্য পরিস্থিতি ভালো নয়'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক বায়িং হাউসের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান টিবিএসকে বলেন, এক কোরিয়ান ক্রেতার একজন প্রতিনিধি গত নয় দিন ধরে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন।
কিন্তু বিরোধী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধের কারণে ওই প্রতিনিধি মাত্র দুই দিন ব্যবসার কাজ করতে পেরেছেন। বাকি সময় তাকে হোটেলে কাটাতে হয়েছে।
কোরিয়ান ক্রেতার প্রতিনিধি এখন তাদের কোরিয়ার কার্যালয়ে প্রতিদিন ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপডেট পাঠাচ্ছেন জানিয়ে ওই ক্রয় কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের ব্যবসার জন্য পরিস্থিতি ভালো নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এখন আগামী সপ্তাহে দুজন ক্রেতার সাথে দেখা করতে কোরিয়া যেতে হবে। অথচ তাদেরই আসলে বাংলাদেশ সফর করার কথা ছিল। এতে আমাদের ব্যবসার খরচও বাড়ছে।'
আরও উদ্বেগ প্রকাশ করে ওই বায়িং হাউস প্রতিনিধি বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে জানুয়ারি থেকে ব্যবসায় ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ লোকসান হতে পারে।
একটি প্রখ্যাত ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের একজন প্রতিনিধিও প্রায় একই সুরে জানান, আগে তাদের প্রধান কার্যালয় মাসে একবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে খোঁজ নিত। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন ব্রিফিং করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নেতিবাচক সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এরকম পদক্ষেপ এলে তাদের ব্যবসার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
ওই প্রতিনিধি বলেন, চীন ও রাশিয়া বাদে বেশিরভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাক কেনা গ্রাহকরা থেকে যেতে পারে, তবে বাকি দেশগুলো অন্যান্য দেশে বিকল্প খুঁজতে পারে।
'কোনো ক্রেতা যদি অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আগের দেশে ফিরতে ৩ থেকে ৫ বছর সময় লাগতে পারে,' বলেন তিনি।
ব্যবসায়ী নেতারা আত্মবিশ্বাসী
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের এই উদ্বেগের বিপরীতে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী নেতারা আস্থার সঙ্গে বলেছেন যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে চলমান অনিশ্চয়তা পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে না।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে নতুন ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরু করেছে, তবে এটি এখন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায় কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি। তিনি বলেন, 'আশা করি ভবিষ্যতে এর প্রভাব পড়বে না।'
ফারুক হাসান আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রাজনীতিকে ব্যবসা থেকে আলাদা রাখতে পারে। দুটি ক্ষেত্রকে দেশটি একসঙ্গে না-ও মেলাতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অঙ্গীকারের পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা কম।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান জোর দিয়ে বলেন যে ব্যবসার গতিশীলতা সহজাতভাবেই চাহিদা ও সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত।
বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি এস এম মান্নান কচিও অনেকটা একই সুরে বলেন, পোশাক ব্যবসা 'চ্যারিটি' নয়, বাজারের গতিশীলতার দ্বারা পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক দামে এ ধরনের পোশাক সোর্স করার বিকল্প যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে খুব বেশি নেই। বাংলাদেশ এই চাহিদা পূরণের গুরুত্বপূর্ণ উৎস রয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, পোশাক শিল্প শ্রমঘন হওয়ায় পোশাক রপ্তানিকারকদের বিরুদ্ধে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তিনি বলেন, 'তারা যদি গার্মেন্টসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দেবে, যার ফলে তাদের নিজেদের দেশেও বড় প্রভাব পড়বে।'
সরকারি পর্যায়ে আলোচনা ও সামাজিক সংলাপের আহ্বান
গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে দেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বৈঠক করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন মার্কিন শ্রম অধিকার নীতির বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানা।
বৈঠক শেষে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সরকার এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা ও শ্রম নীতি ব্যবসার জন্য উদ্বেগের কারণ হবে না, এগুলো সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি মিরান আলী বলেন, সাম্প্রতিক ক্রেতা ফোরামের বৈঠকে কিছু ক্রেতা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য বাধার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, 'আমরা তাদের জানিয়েছি যে জাতীয় নির্বাচনের কারণে এক বা দুই দিনের জন্য ব্যাঘাত ঘটতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, সরকার সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক বিষয়, যেমন ভিসা নীতি ও অন্যান্য উদ্বেগের সমাধান করছে। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে বড় কোনো উদ্বেগ নেই বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।