ডালের দাম আকাশছোঁয়া, ব্যবসায়ীরা বলছেন ডলার সংকটের প্রভাব
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অস্থির হয়ে উঠেছে প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ডালজাতীয় পণ্যের মূল্য। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত এক মাসের মধ্যে ডালজাতীয় প্রতিটি পণ্যের দাম কেজিতে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এরমধ্যে গত একসপ্তাহেই সর্বোচ্চ বেড়েছে এসব পণ্যের দাম।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ডালের চাহিদা পূরণে বড় অংশই আমদানি করা হয়। চলমান ডলার সংকটের কারণে আমদানি বিল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ডালের দামে।
ডালজাতীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মুগ ডালের দাম। বর্তমানে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়, যা এক মাস আগেও ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে, এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি মুগ ডালের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা।
একই সময়ে কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে মটর ডালের দামও। এক মাস আগে ৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি মটর ডাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়।
বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা মসুর (অস্ট্রেলিয়ান) ১০২ টাকা এবং চিকন মসুর (দেশি ও ভারতীয়) ১৩৪-১৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রতি কেজি মোটা মসুর ৯০ টাকা এবং চিকন মসুর ১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
এছাড়া এক মাস আগে প্রতি কেজি ছোলা ৯০ টাকার নিচে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়।
চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে সব ধরনের ডালের দাম বেড়ে বর্তমানে চিকন বা দেশি মসুর ডাল কেজি ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা, মোটা মসুর ডাল ১১০ টাকা, মুগ ডাল ১৮০ টাকা, মটর ডাল ৯০ টাকা এবং ছোলা ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের ডালজাতীয় ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স আমান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমান উল্লাহ বলেন, গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই ডালজাতীয় প্রায় সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। তবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, যা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে এই ব্যবসায়ী বলেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো সাধারণ ব্যবসায়ীদের ভোগ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলছে না। এতে দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
ফলে চাহিদা স্বাভাবিক থাকলেও আমদানিকারকদের বাড়তি মুনাফা করার প্রবণতায় এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে বলে জানান তিনি।
তবে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডালজাতীয় পণ্যের বুকিং দর বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। ১২০-১২৫ শতাংশ মার্জিন দিয়েও আমদানিকারকেরা পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছেন না।
তাছাড়া ডলারের অস্থির মূল্যের কারণে অনেক আমদানিকারক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এসব কারণে পণ্য আমদানি কমে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক টিবিএসকে বলেন, 'অনেক ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার আবেদন করলেও ডলার সংকটের কারণে আমরা সবাইকে এলসি দিতে পারছি না। এখন আমদানির ঋণপত্র খোলার অনুমোদন পাওয়া ব্যাংক ও আমদানিকারকের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। তাছাড়া এলসি ভ্যালু বেশি হলে ডলারের বাড়তি বিনিময় মূল্য গুনতে হচ্ছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও বেশিরভাগ ব্যাংক তা মানতে পারছে না বলে স্বীকার করেন খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের বাজারে মসুর, মুগ, মটর, ছোলা, মাষকলাই ও খেসারিসহ ৭-৮ ধরনের ডাল বিক্রি হয়। দেশে বর্তমানে ডালের বার্ষিক চাহিদা ২৫ থেকে ২৬ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ টন দেশে উৎপাদন হয়। বাকি ১৫-১৬ লাখ টনের চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মটর ডাল আমদানি হয়েছে মাত্র ৭৪ হাজার ২৫২ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার টন। এই সময়ে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার টন; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ছিল বছর ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সময়ে ১৫ হাজার ৩৮ টন ছোলা আমদানি হলেও এবার আমদানি হয়েছে ৩৭ হাজার ৬৯৪ টন।