নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো
শীতকালীন সবজিতে ভরপুর রাজধানীর কাঁচাবাজার। আগের তুলনায় বর্তমানে চাঁদাবাজির সুযোগ কমে যাওয়ায় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবহন খরচও কমেছে। তবে তা সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী নিত্যপণ্যের দাম কমেনি বলে অভিযোগ ভোক্তাদের।
ঢাকার কল্যাণপুর নতুন বাজারে কথা হয় ক্রেতা মোহম্মদ সিফাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, "বাজার ভরা শীতের সবজি, কিন্তু সেই তুলনায় দাম কমেনি। এখনও নতুন আলু কিনতে হচ্ছে ৯০ টাকা কেজি। সিম ৬০ টাকা কেজি।"
"আমরা আসলে বর্তমান সরকারের কাছে আরও বেশি প্রত্যাশা করি। যেহেতু কিছু পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে। এখন পরিবহন চাঁদাবাজি কমেছে, তাই আমরা চাই দাম আরও কমুক," যোগ করেন তিনি।
ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পড়া শেষ করে চাকরি খুঁজছেন সিফাত। থাকেন কল্যাণপুরে একটি রুমে আরও ৩ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে।
তিনি আরও বলেন, "মেস জীবনে খাওয়া নিয়ে সমস্যা থাকে আমাদের। খুব হিসেব করে চলতে হয়। এখন প্রতি বেলা খাবার খরচ হয় প্রায় ৭০ টাকা। প্রতিনিয়ত খরচ বাড়ছে, এদিকে চাকরি নেই; পরিবার থেকে আর কতো টাকা আনা যায়?"
কল্যাণপুর নতুন বাজারের কাছেই কল্যাণপুর বস্তি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ঘরের ভেতরেই সিলিন্ডার গ্যাসে ফুলকপি রান্না করছেন নিরু তাজ।
বললেন, "ভোলা থেকে এসেছি প্রায় ২৫ বছর। নদী ভাঙনে বসতভিটা ও ফসলি জমি সব শেষ হয়ে গেছে। ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরি করি এক বছর। চোখে কম দেখি, তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। স্বামী শ্রমিকের কাজ করে, সেই আয় দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে।"
সবজি, ডাল খেয়েই বেশিরভাগ দিন পার করতে হয় হয় নিরু তাজের। এরপরও ৪ জনের সংসারে প্রতিদিন ৫০০ টাকা খরচ হয় খাবার জন্য। মাছ মাসে দুইবার কেনা হয়, সেটাও পাঙ্গাস এবং তেলাপিয়া।
"ব্রয়লার মুরগি এখন মাসে একবারও কিনতে পারি না। এককেজি ১৯০ টাকা দাম। সেটা রান্না করতে আরও অনেক মসলা প্রয়োজন হয়। এখন এই শীতের সময়ও বেশিরভাগ সবজির কেজি ৫০ টাকার বেশি।"
"টাকার অভাবে চোখের চিকিৎসা করাতে পারছি না। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে চাল, তেলসহ কিছু পণ্য কিনতে পারি, এতে কিছুটা উপকার হয়," যোগ করেন তিনি।
সরকারি উদ্যোগে ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে চাল-আটাসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করে থাকে। এতে কিছুটা উপকৃত হন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
নিরু তাজের পাশে থাকা লিপি আক্তার বলেন, "আমরা টিসিবির কার্ডও পাই না। বেশিরভাগ সময় শুটকি মাছ, সবজি, ডাল দিয়েই ভাত খেয়ে দিন পার করতে হয়। বড় মাছ , গরুর গোসতো কেনার সাহস করিনা। মাসে দুই বার ছোট মাছ কিনি। গতকাল ছোট তেলাপিয়া মাছ কিনেছি ২০০ টাকা কেজি।"
লিপি আক্তার দুই বাসায় রান্নার ও ঘর মোছার কাজসহ ৬টি কাজ করেন; সেখান থেকে তার মাসিক আয় ৬,০০০ টাকা।
তিনি জানালেন, "ছেলেটাকে মাদ্রাসায় দিয়েছি, সেখানে থাকা খাওয়া মিলে প্রতি মাসে ৮,০০০ টাকা দিতে হয়। স্বামী রিক্সা চালায়, কখনও নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। দুই জনের আয়েও সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। নেত্রকোনাতে ভোটার, তাই এখানে টিসিবির কার্ড আমাদের দেয় না। সংসার চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।"
কাঁচাবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি
এ সপ্তাহে দেশের বড় শহরগুলোর ভোগ্যপণ্যের বাজার ঘুরে দেখা গেছে– পেঁয়াজ, আলু এবং ডিমের দাম কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম।
চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি এবং ঢাকার কল্যাণপুর, হাতিরপুল ও কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র।
বাজারে প্রতিকেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, কাতল ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা, চাষের কই ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা এবং শিং মাছ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।
এছাড়া, পাবদা প্রতিকেজি ৪০০ টাকা, রুই ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।
ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের বিক্রয় সহকারী আলী হোসেন টিবিএসকে বলেন, "নতুন চাল আসায় সপ্তাহের ব্যবধানে বিআর-২৮ চালের দাম ৪ টাকা কমেছে। নতুন এ চাল এখন ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।"
এছাড়া, পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ টাকা ও আলু কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। আর সপ্তাহ ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনের কমেছে ৫ টাকা।
চট্টগ্রাম চাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, "আমদানির ফলে চালের বাজার স্থিতিশীল হলেও দাম কমেনি। তবে বাজারে নতুন মৌসুমের আমন চালের সরবরাহ বাড়লে আগামী সপ্তাহ দুই-একের মধ্যে দাম কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।"
বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম
বাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বেড়েছে।
এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের গায়ে সর্বোচ্চ মূল্য ১৬৭ টাকা লেখা থাকলেও নেওয়া হচ্ছে ১৭৫ টাকা। ৫ লিটারের বোতলের দাম রাখা হচ্ছে ৮৪০ টাকা- যদিও বোতলের গায়ে সর্বোচ্চ দাম ৮১৮ টাকা লেখা আছে।
সোমবার নতুন করে দাম নির্ধারণের পর ভোজ্যতেলের সরবরাহ বেড়েছে দোকানে। তবে নতুন দামে সিল করা বোতলজাত তেল বাজারে এখনও আসেনি। তা সত্ত্বেও পুরানো মোড়কের ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে।
চট্টগ্রাম নগরীর জামাল খান এলাকার মুদি দোকানদার জান্নাত স্টোরের স্বত্বাধিকারী নুরুল আবছার বলেন, "ভোজ্যতেল ছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে।"
আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্যের সরবরাহ বাড়লে দাম আরও কমে আসবে বলে মনে করছেন এই ব্যবসায়ী।
কারওয়ান বাজারের তেল বিক্রেতা মোহম্মদ রিয়াদ বলেন, "আমরা তখন তেলের সঙ্গে আটা, চা পাতাও কিনেছি; এখন তাই আগের দামে বিক্রি করলে আমাদের ক্ষতি হবে। বোতলে ৮১৮ টাকা দাম লেখা থাকলেও ৫ লিটার তেল বিক্রি করছি ৮৫০ টাকা।"
এদিকে, সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে শীতকালীন সবজির দাম। চট্টগ্রামে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে— বেগুন ৫০-৭০ টাকা, ফুলকপি ৪০-৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০-৪০ টাকা, মুলা ৩০-৪০ টাকা, শিম ৬০-৮০ টাকা এবং লাউ ৩০-৪০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
গত দুই সপ্তাহ আগে এসব সবজির দাম বর্তমান সময়ের চেয়ে কেজিতে কমপক্ষে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বেশি ছিল।
তবে আলু দাম নিয়ে হতাশা দেখা গেছে ভোক্তাদের মধ্যে।
বাজারে নতুন আলু কেজিতে ২০-৩০ টাকা কমে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও এই দামকে অনেক বেশি বলে মনে করছেন ভোক্তারা।
এদিকে, পুরনো আলু কেজিতে ১০ টাকা কমে ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই সময়ে প্রতিকেজি আলুর দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা।
প্রতি বছর, নভেম্বরে নতুন ফসল আসার আগে আলুর দাম কিছুটা বাড়ে।
২০২২ সালে, আলুর সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ২৫ টাকা কেজি, ২০২১ সালে যা ছিল ২৮ টাকা। তবে, ২০২০ সালের একই সময়ে দেশে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকায় পৌঁছেছিল।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেছেন।
সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা এবং সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "পর্যাপ্ত ভোজ্য তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।"
শফিকুল আলম বলেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং মূল্য পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাজারে তদারকি এবং দামের ক্ষেত্রে অনিয়ম মোকাবেলায় একটি ডেডিকেটেড কমিশন গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।