যে কারণে চট্টগ্রামের শপিং মলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ছে
চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি এলাকার শপিং মল ইউনুসকো সিটি সেন্টারে ২০০৮ সালের দিকে ব্যবসায়ী মো. জুনায়েদ তার কাতারপ্রবাসী ভগ্নিপতিকে ১৩০ স্কয়ার ফুটের একটি এবং সৌদি আরবপ্রবাসী ভাগনেকে ১৭৩ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান কিনে দিয়েছিলেন।
সে সময় দোকান দু'টির প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম পড়েছিল প্রায় ১৮ হাজার টাকা। বর্তমানে যার বিক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০ হাজার টাকা।
ব্যবসায়ী মো. জুনায়েদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০০২-২০০৮ সালের দিকে দোকানগুলোর বুকিং দেওয়া হয়। এরপর ২০০৮ সালে হস্তান্তর করা হয়। প্রবাসী ভগ্নিপতি ও ভাগনে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে দোকানগুলো কিনেছিলেন। কিস্তিতে ধীরে ধীরে পরিশোধ করেছেন। এখন তা দামি সম্পদে পরিণত হয়েছে।"
নগরায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক নগরীতে লাখ লাখ মানুষ এসেছেন। এর সঙ্গে মানুষের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মার্কেট-কমপ্লেক্স। আর জনপ্রিয় হয়েছে শপিংমল।
এক সময় চট্টগ্রাম নগরীর মানুষ কেনাকাটার জন্য রিয়াজুদ্দিন বাজার, নিউ মার্কেট, হকার্স মার্কেটের ওপর নির্ভর করত। গত এক দশকের ব্যবধানে শপিং মলের প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে। পোশাক-জুতার মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নামি-দামি ও দেশ-বিদেশের ব্র্যান্ড শপিং মলগুলোতে এসেছে।
গত এক দশকে চট্টগ্রাম নগরীতে ২০টিরও বেশি শপিং মল গড়ে উঠেছে। মানুষের চাহিদার সঙ্গে এসব বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ও স্পেস ক্রয়েও আগ্রহ বেড়েছে।
ব্যবসায়ীদের বলছেন, আবাসন খাতের ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের তুলনায় শপিং মলের মতো বাণিজিক্য ভবনে বিনিয়োগের মূল্য দিন দিন বাড়ছে। এক দিকে নিরাপদ বিনিয়োগ, অন্যদিকে ভাড়ার পরিমাণও বেশি। এজন্য গচ্ছিত টাকা ফেলে না রেখে মানুষ শপিং মলের দোকান ক্রয়ে বিনিয়োগ করছেন।
চট্টগ্রাম নগরীতে ২০০২-০৩ সালের দকে চালু হয়েছিল লালখানবাজার মোড়ের প্রথম এসি শপিং মল আমিন সেন্টার। এরপর ২০০৬ সালে চালু হয় সানমার ওশান সিটি এবং ২০০৮ সালে ইউনোসকো সিটি সেন্টার।
ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত সানমার ওশান সিটি চালুর পর শপিং মল সংস্কৃতিরও সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। এরপর আগ্রাবাদ এলাকায় আক্তারুজ্জামান সেন্টার, এক্সেস রোডের সিটি শপিং মল, পাঁচলাইশ এলাকার বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে এএফএমআই প্লাজা, ফরচুন মল ও কেবিএইচ প্লাজা, দুই নম্বর গেট এলাকায় ফিনলে স্কয়ার, চকবাজার এলাকায় বালি আর্কেড, এসএএফ আমিন শপিং মল ও সুবস্তি সৈয়দ সেন্টার, খুলশীর জাকির হোসেন রোড় এলাকার সিপিডিএল রহিমা প্লাজা, খুলশী টাউন সেন্টার ও প্লাজা ডিই সিপিডিএল, ফয়জ লেক এলাকায় ফয়েজ লেক সিটি সেন্টার, অলংকার এলাকায় হ্যাভেন সিটি সেন্টার ও অলংকার শপিং কমপ্লেক্স, বহাদ্দারহাট এলাকায় ফিনলে সাউথ সিটি, ইলিজি স্কাই পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।
শপিং মলগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ২০০৬ সালে সানমার সিটির দোকানগুলোর স্থানভেদে প্রতি স্কয়ার ফুটের ক্রয়মূল্য ছিল চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা। কভিড-১৯ মহামারির আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য দাঁড়ায় ৫৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।
২০১৭ সালে নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় চালু হওয়া জমজমাট শপিং মল ফিনলে স্কয়ারের দোকানগুলোর প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য ছিল ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে তা ৪৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।
২০২১ সালে নগরীর চকবাজারের বালি আর্কিডের প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য ছিল ৩১ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে তা ৪০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার টাকা।
প্রবর্তক মোড়ের ফরচুন মলের প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য ২০১৯ সালে ছিল ৪৫ হাজার থেকে ৬৫ হাজার ছিল। বর্তমানে তা ৫৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।
অপরদিকে ২০১৯ সালে দক্ষিণ খুলশীতে আবাসিক ভবনে প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য ছিল সাড়ে সাত হাজার থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা, উত্তর খুলশীতেও তা সাড়ে আট হাজার থেকে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা ও নাসিরাবাদে সাত হাজার ২০০ টাকা ছিল। বর্তমানে দক্ষিণ খুলশীতে আবাসিক ভবনে প্রতি স্কয়ার ফুটের মূল্য ছিল সাড়ে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, উত্তর খুলশীতেও তা ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা, নাসিরাবাদে ১১ হাজার টাকা।
সানমার ওশান সিটি ও নাসিরাবাদের ফিনলে স্কয়ার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আসাদ ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, "শপিংমলের বিনিয়োগকে একইসঙ্গে নিরাপদ ও দ্রুত বর্ধনশীল ধরা হয়। এজন্য প্রবাসীরা, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, অবসরপ্রাপ্ত মানুষেরা দোকান ক্রয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকেন। বছর বছর দোকানের মূল্য বাড়তে থাকে। এছাড়া মার্কেট জমজমাট হলে ভালো ভাড়াও পাওয়া যায়।"
তিনি আরো বলেন, "সামনার ও ফিনলে স্কয়ারে মোট পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে। এর দোকানের ৭০ শতাংশের বেশির মালিক প্রবাসী। বাকিরা অন্য পেশার।"
ইউনোসকো সিটি সেন্টার দোকান মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যবসায়ী মো. জুনায়েদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের মার্কেটের ৯০ শতাংশই প্রবাসী। এ খাতে বিনিয়োগে লোকসান বা অবমূল্যায়নের সম্ভবনা নেই।"
মিক্সড ইউজড বিল্ডিংয়ের যুগে প্রবেশের অপেক্ষায় চট্টগ্রাম
মিক্সড ইউজ বিল্ডিং অর্থাৎ একটি বহুতল ভবনে নাগরিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, যা একুশ শতকের রিয়েল এস্টেট খাতের একটি জনপ্রিয় ধারণা।
প্রথমবারের মতো বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এমন স্থাপনা নির্মাণ করছে দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ মেরিডিয়ান। 'মেরিডিয়ান কোহিনুর সিটি' নামে নগরীর দামপাড়া ওয়াসা সড়কে প্রায় এক একর জমিতে ২৩ তলা বিশিষ্ট মিক্সড ইউজ বিল্ডিংটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের রিয়েল এস্টেট খাতে এমন নির্মাণ একেবারে নতুন। একটি ভবনে চার তারকা হোটেল, শপিংমল, ফুডকোর্ট, রেস্তোঁরা, সুবিশাল গেইমিং জোন, সিনেপ্লেক্স- বহুমাত্রিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভবনটি এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যেন একজন পর্যটক বা বাসিন্দা আধুনিক নাগরিক জীবনের আমোদ-প্রমোদ, বিনোদনসহ সকল সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। অর্থাৎ এটি শুধু শপিং মল নয়, এক্সপেরিয়েন্স মলও। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটি সম্পন্নের পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
মেরিডিয়ান কোহিনুর সিটির পরিচালক (বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) আকিব কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামে জমির দাম তুলনামূলক বেশি। এজন্য সাধারণত স্থাপনা নির্মাণের সময় বাণিজ্যিক দিক বিবেচনায় রাখা হয়। আমরা এদিক থেকে ভিন্ন চিন্তা করেছি। মানুষের চিত্তবিনোদনের বিষয়টিকে প্রধান্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্থাপত্যশৈলীতে ভবনটি নির্মাণ করছি।''
তিনি আরও বলেন, ''পুরো ভবনের মোট স্পেসের ৫২ শতাংশ কমন এবং বাকি ৪৮ শতাংশ বাণিজ্যিক উদ্দেশে রাখা হয়েছে। দেশ-বিদেশের অনেক ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে বুকিং দিয়েছে।"