তিন বছরেও বিসিককে প্লট ফির ১৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি সাভারের ৭৬% ট্যানারি
সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কারখানা গড়ে তোলার জন্য জমি বরাদ্দ পাওয়ার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনকে (বিসিক) মূল্য পরিশোধ করছে না ৭৬ শতাংশ ট্যানারি মালিক।
বিসিকের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০২১ সালের জুনে। সে সময় রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তর করা হয়। ট্যানারি মালিকরা এই সময়ের মধ্যে জমির মূল্য পরিশোধ করবে বলে আশা করেছিল বিসিক।
বিসিকের তথ্যমতে, বর্তমানে জমির মূল্য বাবদ সাভারের ১৬২টি ট্যানারির মধ্যে ১২১টি ট্যানারি মালিকের কাছে বিসিকের পাওনা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিকের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্পটি তিন বছর আগে শেষ হয়েছে। এরপর থেকে একাধিকবার লিজ ডিড সম্পন্ন করার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। অনিবন্ধিত প্লটগুলো বাতিল করা হবে বলেও ট্যানারি মালিকদের সতর্ক করা হয়েছে। এরপরও তারা এটি গ্রাহ্য করেনি।'
ট্যানারি মালিকরা যারা নির্ধারিত সময়ে নিবন্ধন নেননি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেননি, তাদের জন্য ৫ শতাংশ সুদ আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য মালিকদের উৎসাহিত করতে সুদমুক্ত সুবিধা দিয়েছে বিসিক।
বিসিকের ওই কর্মকর্তা বলেন, 'অনিবন্ধিত ট্যানারিগুলোর সুদমুক্ত ফি পরিশোধের জন্য চলতি বছরের ২৪ মে পর্যন্ত আরেকবার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বিসিক।' এই সময়ের মধ্যে জমির মালিকানা বুঝে না নিলে বিসিক কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি।
সাভার শিল্পনগরীতে কর্মরত বিসিকের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, 'সুদমুক্ত ফি পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার পরও রেজিষ্ট্রিশনে সাড়া খুবই কম।'
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'আর্থিক সমস্যার কারণে অনেকে মালিকানা বুঝে নেননি। আবার প্লটের মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তর নিয়ে নীতিমালাও ছিল না, এখন হয়েছে।' তাই সবাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সুদমুক্ত মূল্য পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার পরও সাড়া কমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিষয়টি খোঁজ নেব। যারা রেজিস্ট্রেশন নেননি, তাদের উৎসাহিত করা হবে।'
ট্যানারিগুলো যখন হাজারীবাগে ছিল, তখন বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হতো। এতে ব্যাপক দূষণের কবলে পড়ে বুড়িগঙ্গা। নদী বাঁচাতে হাজারীবাগের সব ট্যানারিকে এক জায়গায় আনতে সাভার চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়।
ধরেশ্বরী নদীর তীরে ১৯৯ একর জমির ওপর এক হাজার কোটিরও বেশি টাকায় ব্যয়ে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলেছে বিসিক। এতে প্লট রয়েছে ২০৫টি, যা বরাদ্দ পেয়েছে ১৬২টি ট্যানারি। কেউ একটা প্লট, আবার কেউ একাধিক প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। এসব প্লট ১০ হাজার বর্গফুট থেকে ৩ লাখ বর্গফুটের।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, প্রজেক্ট ফাইন্যান্সিংয়ের অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঋণ হিসেবে অর্থ নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বিসিক। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ৫ শতাংশ সুদসহ সরকারকে টাকা ফেরত দিতে হবে।
ফি পরিশোধ করে জমির লিড ডিড সম্পন্ন না করায় বিসিক টাকাও পাচ্ছে না, আবার সরকারকে টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, সাভার শিল্পনগরীর প্রতি বর্গফুট জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৭০০ টাকা। তবে ট্যানারি মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্য কমিয়ে ৪৯৯ টাকা করা হয়, যা প্রকল্প শেষ হওয়ার সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু মালিকরা তা পরিশোধ করেননি।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণে। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর ঋণের সঙ্গে ৫ শতাংশ সুদ পরিশোধের কথা ছিল।
তবে বেশিরভাগ ট্যানারি মালিক প্লটের টাকা পরিশোধ না করায় বিসিক এখন সরকারকে টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এ বিষয়ে এখনও কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।
বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ সালে করোনা মহামারি ও পরবর্তীকালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো নয় জানিয়ে মালিকরা জমির রেজিস্ট্রেশন নেননি। ওই সময় মালিকরা জমির মূল্য পরিশোধে সুদ মওকুফ সুবিধা চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন সুদমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও তেমন সাড়া নেই।
গত বছরের ৩০ জুলাই প্লটের মূল্য পরিশোধ করে রেজিষ্ট্রেশন না নেওয়া ট্যানারির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রাখতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটি।
এর আগেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় ট্যানারি শিল্পনগরীরর কার্যক্রম স্থগিত করার সুপারিশ করেছিল পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
যদিও বিসিকের এই প্রকল্প ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা দিলেও সিইটিপি চালু হয়েছে আংশিকভাবে। পরবর্তীকালে সিইটিপির ব্যবস্থাপনা তত্ত্বাবধানের জন্য আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।