রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কিনতে উৎসাহিত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
সরবরাহ বৃদ্ধি ও চাহিদা হ্রাসের কারণে রেমিট্যান্সে ডলারের দাম কমায় ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কিনতে উৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের অন্যতম শর্ত হিসেবে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে এমন নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক-নির্ধারিত সর্বোচ্চ দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বেচাকেনার দায়ে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের জরিমানা মওকুফের দুদিন পরেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি রেটে ডলার কেনার এই নির্দেশনা এল।
আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৯.২৭ বিলিয়ন ডলার। ১৪ মার্চ শেষে আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে দেশের গ্রস রিজার্ভ রয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিপিএম৬ অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভ আরও ৪ বিলিয়ন ডলার কম হবে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের রেট চাচ্ছে ডলারপ্রতি ১১২ থেকে ১১২.৫০ টাকা। কাতার, মালেয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ একাধিক দেশে এই দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে। দুবাইয়ে রেমিট্যান্সের রেট কিছুটা বেশি। ২১ মার্চ দুবাইয়ের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের রেট চেয়েছে ১১৪-১১৫ টাকা।
এছাড়া গত ১৮ মার্চ কয়েকটি ব্যাংক বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে ১১৪-১১৪.৫০ টাকায়। যদিও ফেব্রুয়ারি শেষে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের রেট অফার করছিল ডলারপ্রতি ১২০-১২২ টাকায়। এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে ডলারের এমন দাম ছিল টানা প্রায় ১ বছর।
গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্সের রেট ১০৯.৫০ টাকায় স্থির রয়েছে; এছাড়া আমদানি পেমেন্টে ডলারের দাম স্থির রয়েছে ১১০ টাকায়। যদিও খুব কম ব্যাংকই এই নির্ধারিত রেটে বেচাবিক্রি করছে। বাজারের প্রকৃত দাম এর চেয়েও ৬-৮ টাকা বেশি।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমরা নির্ধারিত রেটেই রেমিট্যান্স কিনছি। আগে আমাদের ব্যাংক রেমিট্যান্সের আহরণের দিক থেকে শীর্ষ পাঁচে থাকলেও এখন ২০ নম্বরেও নেই। কারণ অনেকেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্সের রেট দিচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডেপুটি গভর্নর আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি রেটে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে।'
আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনার কথা টিবিএসকে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, 'ডেপুটি গভর্নর বলেছেন ঈদের মাসকে সামনে রেখে বেশি দামে ডলার কিনতে। আমরা এ বিষয়টি আমাদের মালিকপক্ষকে জানাব। তারা যদি এতে সম্মত হন, তাহলে সেটা চিন্তা করে দেখব।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলো বেশি দাম দিয়ে বেশি ডলার আনলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের থেকে কিনতে পারবে। এটি নিট রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করবে। এছাড়া সোয়াপ পদ্ধতিতে ডলার নিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ বাড়বে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, 'পাচারকারীদের কারণে বাজারে ডলারের দাম বেশি। যখন ডলার পাচার করা হয়েছে, তখন রেট ছিল ৯০-৯৫ টাকা। এখন সেই ডলার দেশে ফিরিয়ে আনলে তারা ডলারপ্রতি ১০-১৫ টাকা বেশি পাচ্ছেন। এরচেয়েও যদি বেশি দামে ব্যাংকগুলো ডলার কেনে, তাহলে পাচারকারীদের জন্য ভালোই হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'ফেব্রুয়ারিতে আমাদের রেমিট্যান্স এসেছে ২.১৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও এই মাসে কখনও এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। এছাড়া কোভিডের মাসেও এই হারে রেমিট্যান্স আসেনি।'
রেমিট্যান্সে ডলারের দাম কমছে
গত এক বছর যাবত নির্ধারিত দামে রেমিট্যান্স কিনতে পারছে না দেশের ব্যাংকগুলো। গত ১২ মাসে রেমিট্যান্সের আনুষ্ঠানিক দাম ১০৫ থেকে ১০৯.৫০ টাকার মধ্যে থাকলেও ব্যাংকগুলোকে এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে রেমিট্যান্স কিনতে হয়েছে তারচেয়েও ১০ টাকা বেশি দরে। যেসব ব্যাংক নির্ধারিত দামে রেমিট্যান্স কিনছে তারা, খুবই সামান্য পরিমাণে সংগ্রহ করতে পেরেছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত ডলারের চাহিদা কমে গেলে এর দামও কমে যায়।
'আগে প্রতি মাসে আমাদের আমদানি পেমেন্ট করতে হতো ৭-৮ বিলিয়ন ডলার। এখন তা কমে ৪-৪.৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রয়েছে। এর ফলে আমাদের রেমিট্যান্সের ডলারের রেট কিছুটা কমছে,' বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে ডলারের দাম ১১০ টাকায় নেমে আসতে পারে।
দেশের ডলার সংকট কিছুটা কমে আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থানও কিছুটা শিথিল হচ্ছে। গেল বছরে অক্টোবরে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে করা ১০ লাখ টাকা জরিমানা মওকুফ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসে দেশের ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলার করে।
এছাড়া ব্যাংকাররা মনে করছেন, যে পরিমাণে রেমিট্যান্স আসছে, তাতে মার্চেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ২.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
তাছাড়া দেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার নিট ওপেন পজিশন ধনাত্মক ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। যদিও দুই মাস আগে এটা ঋণাত্মক ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল।