বিক্রিতে মন্দা, মোহাম্মদপুরের পুড়ে যাওয়া মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে
গত বছর এক ভয়ংকর আগুনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচাবাজারে (কৃষি মার্কেটসংলগ্ন) পুড়ে যায় মাহবুবুর রহমানের দোকান রানা ক্লোথ স্টোর। দোকান পুড়ে যাওয়ায় পর তিনি রাস্তার পাশে কাঠের চৌকিতে বসে পোশাক বিক্রি করতে শুরু করেন।
মার্কেটে দোকান থাকার সময়ও যে পণ্য বিক্রি করতেন, এখনও সেই একই পণ্য বিক্রি করেন মাহুবুবুর। কিন্তু তারপরও ক্রেতারা ভাবেন, তিনি নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করছেন। তাই তারা দামও হাঁকান খুব কম।
রমজানের একদিন মাহবুবুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ক্রেতারা ভাবে আমরা নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করছি। তাই এমন দাম বলে, যে দামে আমরা পণ্য কিনেও আনতে পারিনি।'
গত বছরের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দোকানের মালিক এখন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এবং বাস, কাঠ ও ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে অস্থায়ী কাঠামো পণ্য বিক্রি করছেন।
এই অস্থায়ী দোকান তাদের ভাগ্য ফেরাতে পারেনি। ঈদের মৌসুমেও তারা ক্রেতা পাচ্ছেন না।
মাহবুবুর রহমান বলেন, 'ঈদের এই বিক্রির মৌসুমে স্বাভাবিক সময়ের মতোই বিক্রি নেই। বিক্রি দশ ভাগের এক ভাগও নেই।'
২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে আগুন লাগে মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচাবাজারে (কৃষি মার্কেট)। এ আগুনে ভস্মীভূত ৪০০-র বেশি দোকান।
ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতি বলছে, ওই অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মার্কেটে মুদি, স্টেশনারি, কনফেকশনারি, জুয়েলার্স, প্লাস্টিকের সামগ্রী, চাল, মসলা, ক্রোকারিজ, কাপড়, জুতার দোকান ছিল।
মাহবুবুর রহমান বলেন, '২৩–২৮ বছর ধরে কাপড়ের ব্যবসা করছি। এত দিন ধরে সাজানো আমার দোকানের সব মাল পুড়ে গেছে। প্রায় ১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।'
প্রায় ২৬ বছর ধরে এ মার্কেটে জুতা বিক্রি করছেন ৭০ বছর বয়সি মোহম্মদ সাজাহান । দুটি দোকান পুড়েছে তার। এখন ফুটপাতে বসে জুতা বিক্রি করছেন।
সাজাহান বলেন, 'রমজানের এই সময়ে দুই দোকান মিলে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকার পণ্যও বিক্রি হয়েছে। আর এখন দিনে ১ হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারি না।'
তাকেও ফুটপাতের বিক্রেতা ভেবে কম দাম হাঁকান ক্রেতারা।
'নারীদের দুইজোড়া জুতার দাম বলে ৪০০ টাকা। নিউ মার্কেটের ফুটপাতের জুতার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের,' বলেন সাজাহান।
তিনি আরও বলেন, '২৬ বছর লিবিয়ায় কাজ করে যে আয় করেছি, সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। ২৫ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। এখন ধার করে পণ্য কিনে ব্যবসায় থাকার চেষ্টা করছি।'
ভাই ভাই কসমেটিকসের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, 'এমন সময়ে প্রতিদিন ৩০–৪০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হতো। আর এখন ২–৩ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়।
'ঢাকার চকবাজার থেকে পণ্য কিনে ফুটপাতে অনেকে নকল প্রসাধনী বিক্রি করে। তবে আমরা দীর্ঘদিন একই জায়গায় পণ্য বিক্রি করি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আসল পণ্য বিক্রি করি।'
'তবে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্রি করি বলে এখন ক্রেতারা অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না এখানে আসল পণ্য পাওয়া যায়। যারা পরিচিত ক্রেতা তারা কিছু পণ্য কেনে,' বলেন তিনি।
জসিম উদ্দিন বলেন, 'মার্কেট তৈরির আগপর্যন্ত এভাবেই বসব। আমরা কীভাবে সময় পার করছি সেটা বোঝাতে পারব না। একদিকে বিক্রি নেই, অন্যদিকে পরিবারের খরচ চালাতে হচ্ছে। দ্রুত মার্কেট তৈরি করে আমাদের দোকান যেন বুঝিয়ে দেয়া হয়।'
ঘুরে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া মার্কেটের জায়গায় চলছে নতুন দুইতলা মার্কেটের নির্মাণকাজ। ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে এখন। রড, বালু ইট রাখা রয়েছে, শ্রমিকরা কাজ করছেন। আর নির্মাণাধীন মার্কেটের চারদিকে পণ্য নিয়ে অস্থায়ীভাবে বসছেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের মালিকরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা চান আগামী ঈদ-উল-আজহার আগে যেন নির্মাণাধীন মার্কেটের কাজ শেষ হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও বলছেন, ঈদ-উল-আজহার আগেই সম্ভবত নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে।
ঢাকা উত্তরের জোনাল নির্বাহী কর্মকর্তা (জোন-৫) মুতাকাব্বির আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'প্রথমে আমাদের একটি একতলা শেড করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বাজার কমিটির সাথে আলোচনার মাধ্যমে দোতলা করার পরিকল্পনা হয়েছে। আমরা আশা করছি কোরবানি ঈদের মধ্যে মার্কেটের কাজ শেষ করে ব্যবসায়ীদের বুঝিয়ে দিতে পারব।'
তিনি জানান, 'এ মার্কেটে যেসব ব্যবসায়ীর স্থায়ী বরাদ্দের দোকান ছিল, শুধু তারাই এ নতুন ভবনে দোকান পাবেন।
'এক্ষেত্রে মার্কেট নির্মাণের ব্যয় সিটি কর্পোরেশন বহন করছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের টাকা নেওয়া হবে না; কারণ তারা এ মার্কেটে আগ থেকেই দোকানের স্থায়ী বরাদ্দ নিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'কৃষি মার্কেটের এ অংশে অনেকেই রাস্তার ফুটপাত দখল করে বসতেন এবং জায়গা সংকুলন হতো না। তাদেরকে শেডের মধ্যে নিয়ে আসতেই দোতলা ভবনের পরিকল্পনা।'