জুলাই-এপ্রিলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১২ গুণ
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এ দশ মাসে ব্যাংকগুলো থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে চলতি বছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নেওয়া নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৯ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
সরকার আগের অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ নিয়েছিল। ফলে চলতি অর্থবছরের এ সময়ে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ধার কেন বেড়েছে জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকার সাধারণত বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির মাধ্যমে ধার নিয়ে থাকে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আগের মতো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনছে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এসব বিল ও বন্ড কিনতে হয়।
এছাড়া এসব বিল ও বন্ডে সুদের হার অনেক বেড়েছে বলেও জানান তিনি। ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে এ পরিমাণ সুদ পায় না। সেইসঙ্গে সাধারণ গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের অনিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন ঝুঁকি থাকে।
তিনি আরও বলেন, সরকারকে ঋণ দিলে এসব বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা করতে হয় না। ব্যাংকগুলোর জন্য এটা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করা হয়। এসব কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও ঋণ দেওয়ার বদলে সরকারি বিল ও বন্ড কেনার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বর্তমানে ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১.৩৫ শতাংশ থেকে ১১.৫০ শতাংশ। এছাড়া ২ থেকে ২০ বছর মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করে ১২ শতাংশ থেকে ১২.২৫ শতাংশ সুদ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে সাধারণ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সুদ নিতে পারছে সর্বোচ্চ ১৩.৫৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২২ এপ্রিল শেষে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া সরকারের বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৩৯ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে ৩.০১ লাখ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ১.৩৮ লাখ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ১.৩২ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও এখন পর্যন্ত ধার নিয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৪ শতাংশের মতো। এমনকি গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ৭৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। সে হিসাবে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে।
সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রাপ্যতা প্রভাবিত হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, 'বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা এখন আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এর একটি কারণ হতে পারে সুদের হার বেড়ে যাওয়া।
'এখন বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোও সরকারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে নিয়েছে।'
সরকারকে ধার দেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রাপ্যতা খুব বেশি প্রভাবিত হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার কমানো সরকারের স্থিতিশীলতা ও বিচক্ষণ রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি কমিয়েছে মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মার্চ পর্যন্ত এডিপির বাস্তবায়ন কমেছে।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আমার ধারণা, সরকার অর্থবছরের পুরো সময় শেষেও এডিপি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না-ও করতে পারে। ফলে অর্থবছরের বাকি দুই মাসেও সরকারের ধার লক্ষ্যমাত্রার নিচে থাকতে পারে।
'অর্থাৎ, সরকার ব্যয় সংকোচনের দিকে হাঁটছে। এই পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যয় সংকোচন করার কারণে সরকারি খাতের বিনিয়োগ হয়তো কিছুটা কমবে, তবে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে সরকারের পদক্ষেপ ঠিক বলেই মনে হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'এতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হলেও সরকার একটা নিম্ন ভারসাম্যের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা করছে বলেই আমি মনে করি।'