পাখা গ্রাম: বছরে ৭ কোটি টাকা আয় করে বগুড়ার দুই গ্রাম এখন তালপাখা তৈরির কেন্দ্র
এক বছর আগে ১৯ বছর বয়সি সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে বগুড়া সদর উপজেলার দাঁড়িয়াল গ্রামে। স্বামী আব্দুল হাকিম নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। দেশে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে এ কাজ করতে ভীষণ অসুবিধায় পড়েন আব্দুল হাকিম। এ পরিস্থিতিতে সাদিয়া তার স্বামীর জন্য বিকল্প কাজ খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন।
সাদিয়া জন্মের পর থেকেই তালপাখা তৈরির কাজ দেখে আসছেন। বিয়ের আগে এ কাজ করেছেনও। এ কাজে বেশ দক্ষ সাদিয়া পাখা তৈরির সব কলাকৌশল জানেন।
এ কারণে স্বামীকে নিয়ে আড়োলা গ্রামে বাবা সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে চলে এসেছেন সাদিয়া। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই পাখা তৈরি করছেন। এবার স্বামীকে কাজ শিখিয়ে আগামী মৌসুম থেকে নিজ বাড়িতে তালপাখা তৈরি করবেন সাদিয়া।
এই দম্পতির মতো কাহালুতে আরোলা ও পার্শ্ববর্তী যোগীরভবন গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার বংশ পরম্পরায় পাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। এ দুই গ্রামের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস পাখা তৈরি। তাই দেশের মানুষ এখন এলাকাটিকে 'পাখা গ্রাম' নামেই চেনে।
সাদিয়ার বাবা সিদ্দিকুর রহমান জানান, 'অন্য কোনো কাজের চেয়ে তালপাখা তৈরি করে বিক্রি করা বেশি লাভজনক। শুধু আমি নই, এলাকার সবাই সপরিবারে তালপাখা বানিয়ে সংসার চালান।'
কারিগরা জানান, এ এলাকায় তালপাখা তৈরির মৌসুম বছরের ছয় মাস। মৌসুম শুরু হয় আশ্বিন মাসে। আশ্বিনে তালপাতা সংগ্রহ শুরু। শীতের পর ধুম পড়ে যায় পাখা তৈরির; চলে বর্ষাকাল পর্যন্ত।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ এলাকায় পাঁচ ধরনের পাখা তৈরি হয়। এগুলো হলো—'ডাটা পাখা', 'ঘরুকি পাখা', 'পাটি পাখা', 'পকেট পাখা' ও 'আমান পাখা'। ধরনভেদে পাইকারি বাজারে প্রতি পিস পাখা বিক্রি হয় ১৫ থেকে ৫০ টাকা করে।
হাতে তৈরি এসব পাখার প্রধান দুই কাঁচামাল হচ্ছে তালপাতা ও বাঁশ।
তালপাখার কারিগর এরশাদ আলী জানান, আগে এলাকার পাতা দিয়েই পাখা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এখন পাতারও সংকট। এ কারণে জয়পুরহাট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতা কিনতে হয় চুক্তি করে। আর বাঁশ কিনতে হয় বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে।
এরশাদসহ বাড়ির তিন সদস্য মিলে দিনে ১০০ পিস পাখা তৈরি করতে পারেন। এ কাজে ভালো লাভ হওয়ায় বংশ পরম্পরায় পাখা তৈরি করে আসছেন তারা।
এ দুই গ্রামে পাখা তৈরির ব্যবসা এখন রমরমা হলেও এই এলাকায় এ ব্যবসার গোড়াপত্তনের সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারেন না।
আড়োলা গ্রামের ৯০ বছর বয়সি আব্দুল গফুর তার দাদার কাছে শিখেছেন এই কাজ। এখনও করে যাচ্ছেন। আব্দুল গফুর জানালেন, পাখার দাম যখন দুই আনা ছিল, তখন থেকে তিনি কাজ করছেন। 'ঠিক কতদিন আগে থেকে এখানকার মানুষ পাখা তৈরির সাথে যুক্ত, তা বলতে পারব না। তবে আমার দাদারাও পাখা তৈরির ব্যবসা করতেন। এখন গ্রামের সবাই করে। একে পাখা গ্রাম নামেই চেনে দেশের মানুষ,' বলেন তিনি।
এ ব্যবসা থেকে বাড়তি আয়ের জন্য পুরুষদের পাশাপাশি এলাকার নারীরাও অবসর সময়ে পাখা তৈরি করেন। পাখা তৈরিতে কেন্দ্র করে এই এলাকায় অনেক নারীর কর্মসংস্থানও হয়েছে।
গৃহবধূ তানজিলা বলেন, 'বাবার বাড়িতে [পাখা বানানোর] কাজ শিখেছি। তখন প্রতি পিস পাখায় ৫০ পয়সার বিনিমনে রং করে দিতাম। এখন একটি পাখা রং করলে আড়াই টাকা পাওয়া যায়। গ্রামের অনেক নারী রং আর সেলাইয়ের কাজ করেন। আর পুরুষেরা পাখা তৈরি ও হাতলের কাজ বেশি করেন।'
কারিগর এরশাদ আলী জানান, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের সব অঞ্চল থেকে এখানে পাইকাররা এসে পাখা কিনে নিয়ে যান। তারা বিভিন্ন ওরশ, মেলায় এসব পাখা বিক্রি করেন।
'প্রতি বছর এলাকার প্রতি ঘরে গড়ে অন্তত ৭ লাখ টাকার পাখা তৈরি হয়,' বলেন তিনি।
আজিজার শেখের বাড়ি সিরাজগঞ্জের হাট পাঙ্গাসী এলাকায়। তিনি কয়েক বছর ধরে পাখার ব্যবসা করছেন। আজিজার জানান, বিভিন্ন মেলা ও হাটে এই পাখার চাহিদা বেড়েছে। দামও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হায়দার আলীর বাড়ি যোগীরভবনে। তিনি নিজেও তালপতার পাখার ব্যবসায় যুক্ত। হায়দার বলেন, 'এই দুই গ্রামে প্রায় ১ হাজার ঘর রয়েছে। এ এলাকায় সবাই পাখা বানানোর কাজে জড়িত। এলাকায় বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার পাখা তৈরি হয়।'
হায়দার বলেন, এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে এই ব্যবসার গতি আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) বগুড়ার উপমহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, কাহালুর আড়োলা ও যোগীরভবন, এ দুই গ্রামে অন্তত ৪ হাজার মানুষ পাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে কেউ ঋণের আবেদন করলে নীতিমালার মধ্যে থেকে অবশ্যই তাকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। একইসঙ্গে তাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করবে বিসিক।