আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের শিল্পোৎপাদন ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
চলতি অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটল মেশিনারি), কাঁচামাল এবং শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায়, এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের শিল্পোৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের ওপর।
সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪ অর্থবছরে দেশের ফ্যাক্টরি আউটপুট বা শিল্পোৎপাদনের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে– যা গত বছর ছিল ৮.৩৭ শতাংশ।
এর আগের দুই অর্থবছরে শিল্পোৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৯.৮৬ শতাংশ এবং ১০.২৯ শতাংশ। সে বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধিতে তীব্র পতন দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত আমদানি ব্যয় সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সামগ্রিকভাবে আমদানি কমেছে ১৫.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৪,৯২১.৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫,৮২৭.৪৭ কোটি ডলার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "বিশ্ববাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নানান কারণে আমদানিতে অর্থায়ন করতে পারছে না। প্রধানত, ডলার সংকট; এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার চাপ রয়েছে। রয়েছে বকেয়া পরিশোধের চাপও। যার ফলে আমদানি কমেছে। এতে উৎপাদনও কমেছে। বিনিয়োগ বাড়ছে না। সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।"
তিনি বলেন, আমদানি কমা সত্ত্বেও রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। এর একমাত্র সমাধান হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো।
"সেজন্য রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বাজেট সহায়তা বাড়াতে হবে। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজেটিভ করতে হবে। এরজন্য ডলার-টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল হওয়া জরুরি।"
এভাবে বিনিয়োগ আটকে থাকলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। এতে দেশের ব্যাপক কর্মীবাহিনীর মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১৪.২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২৯৬.৬২ কোটি ডলারের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে আমদানি করা হয়েছিল ৩৪৫.৫৭ কোটি ডলার মূল্যের মধ্যবর্তী পণ্য। এ ধরনের পণ্য সাধারণত শিল্পের ফিনিশড প্রডাক্ট (সবশেষ পণ্য) উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
এর বাইরে অন্যান্য মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ২০.২ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৭১.৫ কোটি ডলারের ক্লিংকার আমদানি হয়েছে। যেটি আগের অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ৯২.৭০ কোটি ডলারের। একইভাবে, তেলবীজ ১০.১ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্য ৭.২ শতাংশ, সার ৪৭.৪ শতাংশ, প্লাস্টিক ও রাবার পণ্য ১৩.৮ শতাংশ এবং লোহা, ইস্পাত ও বেস ধাতু আমদানি কমেছে ৮.৭ শতাংশ।
এই নয় মাসে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক সম্পর্কিত পণ্যের আমদানি কমেছে ৯.১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১,২১৭.২২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক সম্পর্কিত পণ্যের আমদানি কমেছে। আগের অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে এ খাতে ১,৩৩৯.৭৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪.৯ শতাংশ আমদানি কমেছে কাঁচা তুলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২৫৮.৩৪ কোটি ডলারের কাঁচা তুলা আমদানি হয়েছে— যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ৩৪৩.৯০ কোটি ডলারের।
এছাড়া সুতা আমদানি ১০.২ শতাংশ,টেক্সটাইল এবং এর সামগ্রী ৮.২ শতাংশ, ফাইবার ৬.১ শতাংশ এবং ডাইয়িং ও ট্যানিং সামগ্রির আমদানি ৩.১ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন টিবিএসকে বলেন, কাঁচাতুলা ও সুতা আমদানি কম হওয়ার প্রধান কারণ টেক্সটাইল মিলগুলো চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাচ্ছে না। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন কমেছে। এছাড়া চাহিদাও তুলনামুলকভাবে কম।
তিনি বলেন, "অনেক কারখানার আগের মজুদ তুলা বা সুতা থাকার কারণে আমদানি কমেছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক না হলে টেক্সটাইল কারখানাগুলোর উৎপাদন বাড়বে না।"
মূলধনী পণ্য আমদানি পরিস্থিতিও খুব ভালো নয় দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মূলধনী পণ্য আমদানি কমেছে ২২.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে ৮০৬.৭৪ কোটি ডলারের মূলধনী পণ্য আমদানি হয়েছে— যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১,০৪০.৬৮ কোটি ডলার।
এরমধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৩.৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ২৮৪.৮ কোটি ডলার মূল্যের— যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিলো ৩৭৩ কোটি ডলারের। এছাড়া, অন্যান্য মূলধনী পণ্য আমদানি কমেছে ২১.৮ শতাংশ।
লোহা, ইস্পাত ও অন্যান্য বেস মেটাল আমদানি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বিএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, "দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় ধীরগতি হওয়ায় এ ধরনের পণ্যের চাহিদা কমেছে। যে কারণে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমেছে। কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে।"
দেশের শীর্ষ স্থানীয় কনজ্যুমারস গুডস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, "ডলার সংকট, ডলারের উচ্চমূল্য ও কিছু পণ্য অবৈধভাবে বাজারে আসার কারণে বড় বড় আমদানিকারকরা আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।"
আরেকজন আমদানিকারক বলেন, "ব্যাংকগুলো বেশিরভাগ আমদানিকারকের ঋণের সীমা বাড়াচ্ছে না। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরানো সীমিত যে ডলার পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আগের সমান পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না।"
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান টিবিএসকে বলেন, "বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ঠিক রাখতে গত দুই বছর ধরে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের যে পন্থা নিয়ে নিয়েছে এটা তারই ফল।"
তিনি বলেন, "বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তার কারণে মূলধনী পণ্য ও কাঁচামালের চাহিদাও কমেছে। ছোট ছোট আমদানিকারকরা ক্ষতির মুখে পড়ে আমদানি কমিয়েছেন। অন্যদিকে, রপ্তানির চাহিদা তুলনামূলক কম থাকায় আমদানিও কমেছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমদানি কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ আন্ডার ইনভয়েসিং। কারণ ডলারের মূল্য বাড়লেও শুল্ক হারে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এতে একই পণ্য আগের তুলনায় বেশি দাম পড়ছে এবং শুল্কও বেশি দিতে হচ্ছে।"
"বাড়তি শুল্ক এড়িয়ে যেতে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। আমদানি কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগ, উৎপাদন সক্ষমতা, কর্মসংস্থান ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে," যোগ করেন তিনি।
বিবিএস প্রকাশিত ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ের শ্রম শক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকার লোকের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন; গত ডিসেম্বরে যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার জন।