সাভার চামড়া শিল্প নগরী: এবারের ঈদের জন্য কতটা প্রস্তুত?
দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রধান মৌসুম ঈদুল আজহার আর মাত্র একদিন বাকি। ঈদকে সামনে রেখে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সাভারে অবস্থিত বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর ট্যানারিগুলো।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ চামড়াই সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ঈদুল আজহায় কোরবানিকৃত পশুর চামড়া থেকে।
ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে তাই অন্যান্য বছর সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলো বিবেচনায় নিয়ে এ বছর সাভারের চামড়া শিল্প নগরী ও এর কম ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) কর্তৃপক্ষ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছে।
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম শাহনেওয়াজ বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঈদের মৌসুমকে সামনে রেখে বিসিক লেদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের সিইটিপিকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
সব মিলিয়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর তুলনামূলক ভালোভাবে দেশের চামড়া শিল্পের প্রধান এই মৌসুমের সময়টি পার করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন শিল্প নগরীতে অবস্থিত বিভিন্ন ট্যানারির মালিক, মালিক সমিতি, শিল্প নগরী ও সিইটিপি কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে দেখা যায়, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ট্যানারিগুলোতে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। এছাড়াও ঈদের দিন থেকে চামড়া সংগ্রহ ও তা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে মৌসুমের অতিরিক্ত চাপ সামলানোর স্বার্থে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম। এছাড়াও শিল্প নগরী কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সারফেইস ড্রেনগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলমান রয়েছে। কঠিন বর্জ্য অপসারণে খনন করা হচ্ছে দুটি পুকুর।
ঈদের পর ৩ মাস থাকবে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ
বিসিক ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান রিজওয়ান টিবিএসকে জানান, অন্যান্য বছরগুলোতে কোরবানির ঈদের মৌসুমে লোডশেডিংয়ের কারণে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে বেগ পেতে হয়েছে ট্যানারিগুলোকে। এ সময় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি হলে চামড়া নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এসব কারণে এ বছর সংশ্লিষ্ট পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ঈদ-পরবর্তী তিন মাস শিল্প নগরীতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'ব্যতিক্রম কোনো সমস্যা না হলে এই সময়ের মধ্যে শিল্প নগরীকে লোডশেডিংমুক্ত রাখার আশ্বাস দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।'
রিজওয়ান জানান, ঈদের দিন থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত শিল্প নগরীতে আসা চামড়াবোঝাই ট্রাকের চলাচল, চামড়া আনলোডিং এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে অর্ধশতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করবেন।
পাশাপাশি বাধাহীনভাবে শিল্প নগরীতে চামড়া প্রবেশে বিসিক জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও কাজ করবে বলে জানান তিনি।
সিইটিপি ট্রিটমেন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম শাহনেওয়াজ টিবিএসকে বলেন, বিসিক চামড়া শিল্প নগরীতে এ বছর তারা বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তারা ইতিমধ্যে সিইটিপিতে বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে ৪টি ব্লোয়ার ও ৪টি ইকুইলাইজেশন ট্যাংক সক্রিয় করা, ইফ্লুয়েন্ট পাম্পিং স্টেশনের সংস্কার কাজ, বিভিন্ন টেকনিক্যাল ও মেকানিকাল সংস্কার, পানি সরবরাহ নিশ্চিতে ডিপ টিউবওয়েল সক্রিয় করাসহ কঠিন বর্জ্য অপসারণে রাস্তাসহ দুটি পুকুর খনন।
তিনি জানান, গত বছর মাত্র একটি ব্লোয়ার ও একটি ইকুইলাইজেশন ট্যাংক সক্রিয় ছিল।
এদিকে কেমিক্যাল ডোজিং পাম্প সংস্কার করা হয়েছে। একটি ফাইন স্ক্রিন নষ্ট ছিল, সেটিও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রকৌশলী দিয়ে সক্রিয় করা হয়েছে। এতে প্রায় ১.২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানান তিনি।
শাহনেওয়াজ আরও বলেন, শুধু ঈদুল আজহাকে সামনেই রেখেই অন্তত ৭-৮ কোটি টাকার কাজ পাইপলাইনে রয়েছে। এর সবটাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ফান্ড থেকে।
মৌসুমে সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা যে কাজগুলো করেছি, তাতে সিইটিপির সক্ষমতা আপনাআপনিই বেড়ে যাবে।'
প্রি-ট্রিটমেন্ট ও ক্রোম রিকোভারি প্লান্ট ইস্যুতে কোন অবস্থানে রয়েছে ট্যানারিগুলো
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, শিল্প নগরীতে অবস্থিত প্রতিটি ট্যানারিতেই প্রি-ট্রিটমেন্ট বাধ্যতামূলক হলেও শিল্প নগরীর কোনো ট্যানারিই সেটি করছে না। আবার সম্প্রতি শর্তারোপ করে প্রতিটি ট্যানারিতে ক্রোম রিকভারি প্ল্যান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হলেও এর বাস্তবায়নে এখনও কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা জেলা) জহিরুল ইসলাম তালুকদার টিবিএসকে বলেন, সাভারের শিল্প নগরীর কোনো ট্যানারিতেই প্রি-ট্রিটমেন্ট সুবিধা নেই। ক্রোম রিকভারি ইউনিট স্থাপনেও কোনো অগ্রগতি নেই।
তিনি বলেন, প্রি-ট্রিটমেন্ট সুবিধার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না থাকায় অধিদপ্তর আপাতত ট্যানারিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
তবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক মো. সাখাওয়াত বলেন, 'আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ট্যানারিগুলোতে প্রি-ট্রিটমেন্টের অবস্থা এখন অনেক ভালো। প্রি-ট্রিটমেন্টের বিষয়ে কারও ছাড় নেই।
'পরিবেশ অধিদপ্তর তো এই ইস্যুতে ৬টি ট্যানারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছিল। কাজেই এসব অভিযোগের যুক্তি নেই।'
ক্রোম রিকোভারি প্ল্যান্ট স্থাপন ইস্যুতে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এ প্ল্যান্ট সিইটিপি কর্তৃপক্ষের করার কথা। 'আমরা তো সার্ভিস চার্জ, বিল দিচ্ছি। এখন এসে এটি আমাদের ওপর চাপানো অযৌক্তিক।'
১.১০ কোটি চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, এ বছর গরু, মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে মোট ১.১০ কোটি কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের।
গত বছর এ লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি পিস ছিল বলে জানান তিনি।