ডলার প্রবাহ বাড়ায় ২৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ এলসি খোলা হয়েছে মে মাসে
রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় আসা বাড়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে ডলার সরবরাহ। এর জের ধরে মে-তে গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে।
তবে একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি এপ্রিলের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মে মাসে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৬.৮৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খুলেছে।
এরচেয়ে বেশি ৭.০২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল ২০২২ সালের জুন মাসে। এরপর থেকে বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও এলসি খোলা ছিল কমার ধারায়।
চলতি বছরের এপ্রিলে ৫.৬৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। সে হিসাবে এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় মে মাসে এলসি খোলা বেড়েছে ১৯.৫ শতাংশ।
কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের মতে, মে মাসে ডলারের প্রবাহ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি ছিল। এর অন্যতম কারণ, ওই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২.২৫ বিলিয়ন ডলার। এমনিতে চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের কম।
এছাড়া মে মাসে সার্বিক রপ্তানির পরিমাণ কমলেও ব্যাংকগুলোতে রপ্তানি আয় আসা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। মূলত আগে যেসব রপ্তানি করা হয়েছে, সেগুলোর আটকে থাকা পেমেন্ট আসতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলোতে। গত ৮ মে তারিখে বিনিম হারে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু হওয়ার কারণে রপ্তানিকারকেরা ডলারের দাম বেশি পাচ্ছে; ফলে তারা রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আন্তঃব্যাংক ডলার বাজার একটা সময় নিষ্ক্রিয় ছিল। এখন কিছুটা সক্রিয় হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো সেখান থেকে ডলার সংগ্রহ করতে পারছে। ফলে কিছু ব্যাংক রেমিট্যান্স কম পেলেও আন্তঃব্যাংক থেকে ডলার পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে। এসব কারণে এলসিও বেশি খুলতে পারছে।'
দেশের ব্যাংক খাত এখন বিনিময় হারে ক্রলিং পেগ প্রবর্তনের সুফল পাচ্ছে মন্তব্য করে এই ব্যাংকার বলেন, 'ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালু হওয়ায় ডলারের রেট এবং মার্কেট রেটের মধ্যে পার্থক্য অনেক কমে এসেছে। ফলে গ্রাহকরা এলসি খোলার ক্ষেত্রে আস্থা পাচ্ছে।'
মাহবুবুর আরও বলেন, মে মাসে শিল্পের কাঁচামালের মতোই মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলাও বেড়েছে। এটি অর্থনীতির জন্য ভালো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মে মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলারের প্রবাহ ভালো থাকায় তারা এলসি খোলা বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তিনি বলেন, এলসি খোলার চাহিদা সবসময়ই ছিল। তবে আগে তারা আমদানি এলসি খোলার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বাছ-বিচার করতেন। যেমন, আগে কেউ ৫টি এলসি খুলতে এলে তারা মাত্র ২টি খুলতেন। তবে মে মাসে ডলারের প্রবাহ ভালো থাকায় তারা পাঁচটির মধ্যে ৪টি এলসিই খুলেছেন।
জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারি আমদানির এলসি খোলা মে মাসে কিছুটা বেড়েছে, যেটি ব্যাংক খাতে বেশি এলসি খোলার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রেজা ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের ডলারের তারল্য পরিস্থিতি আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন ভালো। আমাদের ব্যাংকে রপ্তানি আয় আসাও বেড়েছে। এছাড়া আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেনও হচ্ছে এখন, ফলে ডলারের প্রবাহ বাড়ছে।'
একটা দীর্ঘ সময় এই বাজারে লেনদেন প্রায় বন্ধ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর ফলে আমরা আমদানি এলসি খোলা বাড়াতে পেরেছি। এটা ধীরে ধীরে আরো ভালোর দিকে যাবে।'
তবে ঈদের কয়েকদিন ব্যাংকগুলো বন্ধ থাকায় জুনে এলসি খোলার পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে বলে জানিয়েছেন একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তিনি বলে, 'এছাড়া আরএমজি ও উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হাউজগুলো দুই ঈদের সময়েই ১০-১৫ দিনের বন্ধ দেয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকায় কাঁচামালের প্রয়োজন কমে যায়। এসব কারণে ঈদের মাসগুলোতে আমদানি এলসি খোলার প্রবণতা কমে যায়।'
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মোট ৬২.০৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়েছে। গত অর্থবছরের ১১ মাসে খোলা হয়েছিল ৬২.০৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি। সে হিসাবে এ সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এলসি খোলা সামান্য বেড়েছে।
মে মাসে এলসি নিষ্পত্তি কিছুটা কমেছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মে মাসে ব্যাংকগুলো আমদানি এলসির পেমেন্ট করেছে ৫.৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিলের তুলনায় ৫ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ডেফার্ড এলসি পেমেন্টের চাপ আগের তুলনায় কমে এসেছে। 'কারণ এক্সচেঞ্জ রেট ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংকগুলো ডেফার্ড এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছিল। এসব কারণে পেমেন্টও কমে এসেছে,' বলেন তিনি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মোট ৬০.৭৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ কম।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, গত দুই বছর এলসি কম খোলার কারণে পেমেন্টের চাপ কমেছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ডলারের দাম রাখছে ১১৮.৪০ থেকে ১১৮.৭০ টাকা। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করছে ১১৭.৮০ থেকে ১১৮.৩০ টাকায়।