উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে আগামী ৫ বছরে যা যা করতে হবে
বর্তমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যগুলো বহুলাংশে অর্জিত নাহলেও– পরেরটির প্রণয়নের কাজ এরমধ্যেই শুরু হয়েছে। আগামী ১৫ বছর বা কাছাকাছি সময়ে – মধ্য আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার মিশন সামনে রেখে – নতুন পরিকল্পনায় সরকারের জন্য আরও উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যবর্তী সময়ে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা এবং মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করাসহ এই পরিকল্পনা প্রণয়নে দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত সংস্কার কর্মসূচির ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে; যা সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বাড়িয়ে বাংলাদেশকে কেবল উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দিকেই এগিয়ে নেবে না, একইসঙ্গে নাগরিকদের জীবনমানও উন্নত করবে।
নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারণাপত্রে মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দুর্বল রাজস্ব আহরণ ও অপর্যাপ্ত বিনিয়োগকে শীর্ষ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে, মধ্য আয়ের দেশের চাহিদার তুলনায় বিদ্যমান শ্রমশক্তির দক্ষতায় একটি 'গুরুত্বপূর্ণ অসামঞ্জস্য' থাকার কথাও স্বীকার করা হয়েছে।
দক্ষতার এই ঘাটতি এবং শিক্ষার দুর্বল মান মোকাবিলায় এতে বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ রয়েছে। ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, "সবার জন্য বাধ্যতামূলক ১২ বছর মেয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করবে।"
খসড়া ধারণাপত্র প্রণয়নে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৪ জুলাই কমিটির প্রথম সভায় এবিষয়েও আলোচনা করা হবে।
স্বাস্থ্য সেবা পেতে বাংলাদেশে মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ খুবই বেশি; এই বাস্তবতায় 'একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা' চালুর মাধ্যমে ৫ থেকে ৬৫ বছরের সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাকেও লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে – ৮ শতাংশের বেশি হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা করেছে। এজন্য বাংলাদেশিদের মাথাপিছু আয় বর্তমানের ২ হাজার ৭৮৪ ডলার থেকে ৪ হাজার ৪৬৬ ডলারে উন্নীত করতে হবে।
সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ এজেন্ডা এবং উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্পের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এই পরিকল্পনা। বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞামতে, উন্নত অর্থনীতির দেশ হতে হলে ২০৪১ সাল নাগাদ মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার ৮৪৬ ডলার বা তার চেয়ে বেশি হতে হবে।
ধারণাপত্রে জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বিস্তৃত সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলা হয়েছে, সুশাসনের জন্য শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের মর্যাদার দিকে চালিত করতে এধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিই ভিত্তি-স্বরূপ ভূমিকা রাখবে।
"এসব সংস্কার আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সহজ করে– আইনের শাসনকে শক্তিশালী করবে; পাশাপাশি স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রসার করবে" বলে আশাপ্রকাশ করা হয়েছে।
সুনীল অর্থনীতির পাশাপাশি মহাকাশ অর্থনীতিকেও আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নবদিগন্তে নিজস্ব স্যাটেলাইটের সুবিধা গ্রহণের পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে।
নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সরকারের রূপকল্প ২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়নের পাশাপাশি এতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহ-ও (এসডিজি) অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সেই বিচারে, আগের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর চেয়ে এটি ব্যতিক্রমীও হবে।
দেশে বহু বছর ধরেই যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়ে আসছে, তারমধ্যে বেশ কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে আগামী পঞ্চবার্ষিকের ধারণাপত্রে। দেশের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এসব সংস্কার আবশ্যক বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আগামী বছরের জুনে শেষ হচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ। তাই একবছর আগে থেকেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় নতুন পঞ্চবার্ষিকের ধারণাপত্রের খসড়াটি প্রস্তুত করেছে। এতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ, এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সমৃদ্ধি ও বিকাশের দিকে চালিত করার কথা বলা হয়েছে।
সামগ্রিক বিনিয়োগকে জিডিপির ৪১ শতাংশে উন্নীত করার জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দিতে এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে রূপান্তরিত করার কথাও বলা হয়েছে। যা করা গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে ৮ শতাংশের উপরে নেওয়া সম্ভব হবে। সরকারের ২০৪১ সালের প্রেক্ষিত পরিকল্পনাতেও একথা বলা হয়েছিল। বর্তমানে জিডিপি অনুপাতে সার্বিক বিনিয়োগ হারের বেঞ্চমার্ক হলো ৩১.৩ শতাংশ।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগসহ দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। বর্তমানে যা জিডিপির অনুপাতে ২৪ শতাংশে রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায়, বিনিয়োগের এই হার যেমন অপর্যাপ্ত তেমনই মন্থর।
উচ্চ মধ্য-আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেকসই ও সুষম প্রবৃদ্ধি অর্জনকে কেন্দ্রে রাখা এই ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, "সরকারি বিনিয়োগ এই ঘাটতি পূরণে অবদান রাখলেও, অভিষ্ট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের জন্য সার্বিক বিনিয়োগের বর্তমান হার যথেষ্ট নয়।"
এতে আরও বলা হয়েছে, নাগরিক-কেন্দ্রিক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, জ্ঞান-ভিত্তিক, সমন্বিত ও দক্ষ স্মার্ট প্রশাসন গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিনিয়োগ, উদ্ভাবন ও সামাজিক অগ্রগতির অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে। পাঠ্যক্রমে এসব বিষয়ের অধ্যায়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহনশীলতার নীতির প্রতিফলন ঘটেছে।
করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের অভিঘাত সত্ত্বেও আগামী জুনে সমাপ্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিকির মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ টেকসই ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
এর প্রতিফলন দেখা যায়, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারে, যেমন ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৩.৪ শতাংশ থেকে দ্রুত বেড়ে তা ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬.৯ শতাংশ হয়। করোনার সময়ে দেওয়া সরকারের প্রণোদনামূলক ঋণকে এজন্য কৃতিত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, এটি মহামারি থেকে অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারে অবদান রাখে। কিন্তু, তারপরেই আসে ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের প্রভাব।
বৈশ্বিক সংঘাতগুলোসহ বেশকিছু সুস্পষ্ট কারণে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাঁচ বছর সময়ে ৮ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি বলেও ধারণাপত্রে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
"তাই নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হবে প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করে অর্থনৈতিক গতিশীলতার পুনরুদ্ধার; সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার দৃঢ়করণ; দারিদ্র্য হ্রাস এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া। তবে একইসঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।"
আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বেসরকারি খাতের এবং সামষ্টিক বিনিয়োগ হারে গতি আনতে কৌশল প্রণয়নে গুরুত্ব দেবে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব থাকবে।
"এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো ২০২৮ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার আরও কমিয়ে ১১ শতাংশ করা, ২০৩১ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্য হার (৩ শতাংশেরও কম) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য হার (৩ শতাংশেরও কমে) নামিয়ে আনা" ধারণাপত্রে বলা হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এপর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের বরাতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দারিদ্র্য হার ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্য হার ৫.৬ শতাংশে নেমে আসে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এই সাফল্যকে পুঁজি করে সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ এবং জলবায়ু ভিশনের সঙ্গে একীভূত হবে।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের পথকে মসৃণ করার দিকে এতে মনোযোগ থাকবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন এবং ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশে বাংলাদেশের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা থাকবে বলেও নথিটিতে বলা হয়েছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং শিপিং, এভিয়েশন ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিভিন্ন সেবাখাতের রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবে।
বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিম্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত। ফলে অবকাঠামো ও সামাজিক খাতগুলোয় অর্থায়নে সরকারের অর্থ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। তাই দেশের বর্ধিত আর্থিক চাহিদা পূরণে নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নতুন ভ্যাট আইন, করনীতি সংস্কার, বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং কর-ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয়করণের ওপর গুরুত্ব দেবে।
এই পরিকল্পনা ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে উন্নত নজরদারি , ঋণ শ্রেণিকরণের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ এবং অর্থঋণ আদালত আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেবে।