উৎপাদন তথ্যে গরমিল, সরবরাহের তুলনায় ডিমের চাহিদা বেশি
নিত্যপণ্যের বাজারে মাছ, সবজি থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুর দাম চড়া হওয়ায় চাহিদা বেড়েছে সস্তা প্রোটিনের উৎস হিসেবে পরিচিত ডিমের।
চাহিদা বাড়লেও এই সময়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় পোল্ট্রি খামার ক্ষতির মুখে পড়ে দিনে প্রায় ৫০ লাখ ডিমের উৎপাদন কমে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যখন বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়, তখন কৃষি বিপনন অধিদপ্তর প্রতিটি ডিমের দাম ১১.৮৭ টাকা বেঁধে দেয়। কিন্তু তাতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না এসে উল্টো দাম আরও বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরকার সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
আমদানির খবরে অবশ্য ডিমের দাম সামান্য কমতে শুরু করলেও ভোক্তাকে এখনও প্রতিটি ডিম ১৪ টাকা বা তারও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে বলে জানান খুচরা বিক্রেতারা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক ডিমের চাহিদা ৫ কোটি পিস। পোল্ট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবে, দেশে দৈনিক ডিমের উৎপাদন ৪.৫ কোটি পিস। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ৫০ লাখ পিস ডিমের উৎপাদন কম হওয়ার কারণে উৎপাদন নেমেছে ৪ কোটিতে।
তবে ডিমের উৎপাদনের ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ডিমের দৈনিক উৎপাদন ৬.৩০ কোটি পিস। এখান থেকে ৫০ লাখ পিস উৎপাদন কমে ৫.৮০ কোটি পিসে নামলেও তা দৈনিক চাহিদার তুলনায় বেশি বলে জানান কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলেন, এই প্রেক্ষাপটে তারা ডিম আমদানির বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। তাদের মতে, অপ্রত্যাশিত বন্যায় যখন বাজারে মাছ, শাকসবজিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে, সে সময় ডিমের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে এবং সে কারণেই ডিমের বাজারে সাময়িক অস্থিরতা।
তারা বলছেন, বৃষ্টি পরিস্থিতি কেটে গেলে যখন শীতের শাকসবজি বাজারে আসতে শুরু করবে, তখনই ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
উৎপাদন তথ্যে গরমিলের কারণ
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রতিদিনের ডিমের উৎপাদন ৬.৩ কোটি পিস। 'উৎপাদনকারীদের তথ্য ও সরকারের তথ্যের ফারাক হওয়ার প্রধান কারণ হলো, হাঁস ও কোয়েলের ডিমের হিসাব ধরা হয় না বেসরকারি হিসাবে। অথচ এ দুটি উৎস থেকে প্রতিদিন অন্তত ১ কোটিরও বেশি ডিম সরবরাহ চেইনে যুক্ত হয়।'
তিনি বলেন, বাজারে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। 'মাছের সরবরাহ কম, সবজির দাম চড়া। অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, বৃষ্টির কারণে শীতের সবজি এখনও বাজারে আসেনি। এই চাপটা পড়েছে ডিমের ওপর, চাহিদা বেড়েছে। তবে এটা সাময়িক, সবজি বাজারে আসতে শুরু করলেই এই চাহিদাটা কমে যাবে, বাজারও স্বাভাবিক হবে।'
তবে ডিমের যে চাহিদা, তা যথাযথভাবে পূরণ করতে হলে আরও এক কোটি পিস ডিমের উৎপাদন বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই ডিমের উদ্বৃত্ত উৎপাদনের হিসাব দিয়ে এলেও মাঝেমধ্যেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। সরকারের হিসাবে প্রায় ৮০ লাখ পিস চাহিদার বেশি উৎপাদন এবং বেসরকারি হিসাবে প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় অন্তত ১ কোটি পিস কম ডিম উৎপাদন হচ্ছে।
ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, বন্যার কারণে উৎপাদন কমেছে। আবার বর্তমান উৎপাদন চাহিদার চেয়েও কম। অন্যদিকে বাজারে সবকিছুর দাম বেশি হওয়ার ক্রেতাদের মধ্যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে ডিমে। এই পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য সরকারের আমদানির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক।
তবে যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক করার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির সর্বশেষ হিসাব তৈরি করেছে গত ৭ অক্টোবর। সে হিসাবে উঠে এসেছে, দক্ষিণ-পুর্বাঞ্চল ও ময়মনসিংহ বিভাগসহ (শেরপুরসহ কয়েকটি জেলায় বন্যা চলছে) মোট ক্ষতিগ্রস্ত জেলার সংখ্যা ১৯টি। এই ১৯ জেলায় ৫ হাজার ৯১৯টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্ব ডিম দিবস
এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজ ১১ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। 'ডিমে পুষ্টি ডিমে শক্তি, ডিমে আছে রোগমুক্তি'—এই স্লোগান সামনে রেখে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পালন করছেন এবারের দিবসটি। প্রতি বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব ডিম দিবস।
ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের রক্ষার আহ্বান
বিপিআইসিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডিমের উৎপাদনের ১৩.৯৬ শতাংশ বা ৬০.০৫ লাখ পিস সরবরাহ করে বড় প্রতিষ্ঠান। বাকি ৮৬.০৪ শতাংশ সরবরাহ আসে ক্ষুদ্র খামারিদের থেকে। এই হিসাব করা হয়েছে বন্যার আগের প্রতিদিনের সাড়ে ৪ কোটি পিস উৎপাদনের তথ্য থেকে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
'আবার অনেকে পানির জমে থাকার কারণে কম দামে দ্রুত মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। কারও কারও মুরগি মরে যাওয়ার কারণে পুঁজি হারিয়েছেন। সব মিলেই ডিমের উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে,' বলেন তিনি।
সুমন হাওলাদার বলেন, 'সাময়িক আমদানির অনুমতি দিলেও সেটা আসলে স্থায়ী সমাধান নয়। কর্পোরেট খামারিদের চাপে দীর্ঘদিন ধরে ছোট খামারিরা উৎপাদন থেকে যেভাবে সরে যাচ্ছে, তাদেরকে ফেরাতে হবে। এর জন্য মুরগির বাচ্চা ও ফিডের দামে সরকারের পরিদর্শন জরুরি হয়ে পড়েছে। সবমিলিয়ে আমাদের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই।'
কম উৎপাদনে ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে নিম্ন-আয়ের মানুষ। কারণ ঢাকার বাজারে ৬০-৬৫ টাকা কেজি দরের আলু ছাড়া সব সবজিই এখন ৮০-১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় নিম্ন-আয়ের মানুষ যখন ডিমের ওপর নির্ভর করছে, তারও খরচ বেড়েছে।