সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রূপপুরের ঋণের আসল ও সুদ পাবে রাশিয়া
ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ আলোচনা শেষে বাংলাদেশ ও রাশিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের মূল অর্থ ও সুদ পরিশোধের বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। এ চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি এ ইস্যুটির একটি সমাধান পাওয়া গিয়েছে।
চুক্তির আওতায় ঢাকার সোনালী ব্যাংকের একটি স্থানীয় শাখায় রাশিয়ার সরকারের নামে একটি বৈদেশিক মুদ্রা অ্যাকাউন্ট খোলা হবে।
রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় এ অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবে এবং রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করে অর্থ স্থানান্তর শুরু করা হবে।
বুধবার (৫ ডিসেম্বর) ইআরডিতে (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ইআরডি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাজ করবে এবং এ অ্যাকাউন্টে ঋণের মূল অর্থ ও সুদ নিয়মিত জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে বৈঠকে রাশিয়ার অ্যাটমসট্রয়এক্সপোর্ট জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (এএসই জেএসসি)-এর আট সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। এছাড়া বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
রাশিয়ার প্রতিনিধিদলে ছিলেন এএসই জেএসসি-এর অর্থ পরিচালক আন্তন কোজিনভ, রুশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডেট অ্যান্ড সভেরেইন ফিনান্সিয়্যাল এজেন্ট বিভাগের পরিচালক ডেনিস মামনভ, এবং ভিইবি.আরএফ-এর গভর্নমেন্ট এজেন্ট অফিসের নির্বাহী পরিচালক মালিয়াভিন ইলিয়া।
রূপপুর প্রকল্পের মোট ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৯০ শতাংশ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে বাংলাদেশ নিয়মিত ভিইবি.আরএফ ব্যাংকের মাধ্যমে সুদ পরিশোধ করত।
তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন ব্যবস্থা ভেঙে যায়। এর ফলে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার সুদ, কমিটমেন্ট ফি এবং জরিমানা বকেয়া হয়ে যায়। ঋণের মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালে।
তবে সোনালী ব্যাংকে প্রস্তাবিত নতুন অ্যাকাউন্টটি শুধু ভবিষ্যতের ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবহৃত হবে। পূর্ববর্তী বকেয়া এ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে না। এসব বকেয়া পরিশোধ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি বলে জানান ইআরডি'র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার পাওনার সম্পূর্ণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছে। তবে রাশিয়া সরাসরি তহবিল ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ চায়। দুই বছর ধরে এ জটিলতা সমাধানের চেষ্টা চলছে।
রাশিয়া এর আগে প্রস্তাব করেছিল, তারা বাংলাদেশে তাদের একটি ব্যাংকের শাখা খুলে ঋণের অর্থ গ্রহণ করবে। তবে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে রুশ সরকারের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত হয়।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, রাশিয়া এ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি মুদ্রা সোয়াপ এবং সুদও আয় করতে পারবে। তবে বকেয়া পাওনার জন্য এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা থাকা অর্থ নতুন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হবে না।
ইআরডির এ কর্মকর্তা আরও জানান, রুশ কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন পেলেই অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
এ পর্যন্ত ৭.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে রাশিয়া
রূপপুর প্রকল্পের জন্য ২০১৬ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার অধীনে ২০১৭ সাল থেকে অর্থ বিতরণ শুরু হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ ঋণ পুরোপুরি বিতরণ হওয়ার কথা ছিল। তবে চলতি বছরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত রাশিয়া ২৫ কিস্তিতে বাংলাদেশকে ৭.৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে।
প্রকল্পটির মোট আনুমানিক ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৯০ শতাংশ (১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার) রাশিয়ার সরকার ঋণ হিসেবে অর্থায়ন করেছে। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে মেটানো হবে।
এছাড়া, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে আরও ৪৯১ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। তবে এ ঋণের শেষ দুটি কিস্তি এখনও পরিশোধ করা হয়নি।
প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া
চুক্তি অনুযায়ী, ঋণ বিতরণের পর প্রতি ছয় মাস অন্তর ঋণের সুদ পরিশোধ করার নিয়ম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে বাংলাদেশ নিয়মিত সুদ পরিশোধ করছিল।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি এসক্রো অ্যাকাউন্টে তহবিল জমা রাখা সত্ত্বেও অর্থ হাতে না পাওয়ায় রাশিয়া সুদ, জরিমানা এবং প্রতিশ্রুতি ফি আদায় করছে। এ সব মিলিয়ে বর্তমানে বকেয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ইআরডি জানিয়েছে, চলতি বছরের ২১ আগস্ট রাশিয়ার ভিইবি.আরএফ ব্যাংক বাংলাদেশকে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬৩০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধের অনুরোধ জানায়। রাশিয়া এ অর্থ চীনের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের প্রস্তাব দিলেও প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ অর্থ প্রদান করতে পারেনি।
ঋণ ছাড় ও পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ
চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের জন্য ঋণ বিতরণের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরেই শেষ হবে। ঋণের মূল অর্থের প্রথম কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ।
প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার গত জুনে রাশিয়াকে ঋণ ছাড় এবং পরিশোধের সময়সীমা দুই বছর বাড়ানোর অনুরোধ করে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পটির ৬৭ দশমিক ৮১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। জুনে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়াকে চিঠি দিয়ে ঋণ বিতরণের সময়সীমা ২০২৬ সাল পর্যন্ত এবং পরিশোধের সময়সীমা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, বকেয়া সুদ পরিশোধের অনিশ্চয়তার মধ্যে রাশিয়ান সরকার এখনো এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, উভয় পক্ষই স্বীকার করেছে যে, রূপপুর প্রকল্পে ঋণ বিতরণের সময়সীমা না বাড়িয়ে এগোনো সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার সরকার শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদি ঋণ বিতরণের সময়সীমা বাড়ানো হয়, তাহলে পরিশোধ শুরুর তারিখও পিছিয়ে যাবে।