বিনিময় হার আরও নমনীয় করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপে অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজার
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে স্টাফ-লেভেল চুক্তির অংশ হিসেবে বিনিময় হারে আরও নমনীয়তা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে। আর এতে ডলারের দামে বড় ধরনের ওঠানামার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আবারও অস্থির হয়ে পড়েছে।
শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং আকর্ষণীয় রপ্তানি আয় থাকা সত্ত্বেও রেমিট্যান্স ডলারের বিনিময় হার গত সপ্তাহে বেড়ে ১২৮ টাকায় পৌঁছেছে, যেখানে নভেম্বর মাসে এ হার ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে ছিল।
এ পরিস্থিতিতে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা এবং রূপালী সোমবার এক বৈঠকে সর্বোচ্চ ১২৩ টাকায় রেমিট্যান্স কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ব্যাংকার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কয়েকটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে এ হার মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে।
বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক এর আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার বর্তমান ১২০ টাকা থেকে ১২৩ টাকায় সংশোধন করতে পারে।
এ হার বাড়ার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিনিময় হারে আরও নমনীয়তা গ্রহণের ফলে ডলারের দাম আরও উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আরও নমনীয়তার অর্থ হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কম হবে। এ নীতির সঙ্গে ব্যাংক এ মাসের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি পর্যালোচনা মিশনের সময় একমত হয়েছিল।
বাংলাদেশের বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা এবং বর্ধিত তহবিল সুবিধার তৃতীয় পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত ১৮ ডিসেম্বর আইএমএফ উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হার সংস্কারের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশে সফরের সময় আইএমএফ-এর মিশন বিনিময় হারের প্রক্রিয়া নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি প্রধানদের সঙ্গেও একটি বৈঠক করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারে আরও নমনীয়তার জন্য সম্মত হওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আইএমএফ-এর আলোচনা শেষ হওয়ার পর ডিসেম্বরের শুরু থেকে ডলারের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে।
আইএমএফ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, 'উদীয়মান বাহ্যিক অর্থায়নের ব্যবধান এবং ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় নিকট-মেয়াদি নীতি কঠোর করা অত্যন্ত জরুরি। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর পাশাপাশি কর ছাড় বন্ধ করার মতো অতিরিক্ত রাজস্ব ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করাকে আর্থিক একত্রীকরণের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
'আর্থিক কঠোরতার সঙ্গে মিল রেখে বৃহত্তর বিনিময় হারের নমনীয়তা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাফারগুলোর সুরক্ষা বাহ্যিক ধাক্কাগুলোর বিরুদ্ধে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়াবে।'
বিনিময় হারে বৃহত্তর নমনীয়তার জন্য আইএমএফ-এর নির্দেশ এমন সময়ে এসেছে, যখন দেশের মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছে। গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর মুদ্রানীতি
বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কঠোর মুদ্রানীতির ফলে ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়বে, যা বিনিয়োগকে প্রভাবিত করবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমে আসবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার প্রবৃদ্ধির চেয়ে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার এবং মূল্যস্ফীতিকে স্থিতিশীল করতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
বর্ধিত সুদের হারের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যে একক সংখ্যায় নেমে এসেছে। এ সুদহার বর্তমানে ১৩ শতাংশের কিছু ওপরে রয়েছে।
স্থিতিশীল রিজার্ভ
তবে ডলারের অস্থিরতা সত্ত্বেও রোববার দেড়মাস পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ বেড়ে আবার ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডলারের দাম ১২০ টাকায় বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন থেকে ২০ বিলিয়নের মধ্যে স্থিতিশীল ছিল।
ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ডলার সংকটের কারণে নয়, বরং একটি বৃহত্তর নমনীয় হার ব্যবস্থার প্রত্যাশায় ডলারে দাম ওঠানামা করেছে।
তিনি আরও জানান, বাজারের কিছু কুশীলব নতুন নমনীয় হারের সুযোগ নিতে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে।
বর্তমান ডলারের প্রবাহের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের সম্মিলিত পরিমাণ আমদানি ব্যয়ের চেয়ে বেশি হওয়ায় ডলারের প্রাথমিক প্রবাহ ডলারের ব্যয়ের তুলনায় বেশি।
নভেম্বর মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মোট প্রবাহ ছিল ৬.৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৪.৭ ডলার বিলিয়ন এসেছে রপ্তানি খাত থেকে এবং ২.২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। এ সময় আমদানি ব্যয় ছিল প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে। মাসের প্রথম ১৯ কার্যদিবসে ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। মাস শেষ হওয়ার আগে এটি ২.৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেট ডলারের দৈনিক উদ্বৃত্ত বর্তমানে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার থাকছে, যেখানে গত বছর এটি ঘাটতিতে ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের সম্মিলিত প্রবাহ ৭.৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁতে পারে। আর আমদানি ব্যয় প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। ফলে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
১২৮ টাকায় ডলার 'অযৌক্তিক'
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান টিবিএসকে বলেন, ডলারের বাজারে তারল্য থাকা সত্ত্বেও ১২৮ টাকার বিনিময় হার একেবারেই অযৌক্তিক।
তিনি জানান, এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো বিনিময় হারের ক্রমবর্ধমান নমনীয়তার সুযোগ নিচ্ছে। তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত ১২৩ টাকার রেটকে যৌক্তিক মনে করেন।
তিনি বলেন, রমজানের আগে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার চাহিদা বাড়ার কারণে ডলারের দাম ১২২–১২৩ টাকায় উঠে গেছে।
এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটের মুখে থাকা কিছু ব্যাংককে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এলসি খোলার অনুমতি এবং তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে ডলারের দাম কিছুটা বেড়েছে।
বকেয়া পরিশোধে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে তাদের বকেয়া পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়ায় ব্যয় পরিশোধের খানিকটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
গত ১২ নভেম্বর জারি করা একটি সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেজারি প্রধানদের সতর্ক করে দিয়ে বলে, আমদানি দায় পরিশোধে বিলম্ব হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি প্রধানদের সঙ্গে দুটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে পেমেন্ট ক্লিয়ারেন্স নিশ্চিত করতে তাদের কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গত অক্টোবরে আমদানি নিষ্পত্তি ৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে, যা দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। নভেম্বরে এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল, যদিও আনুষ্ঠানিক উপাত্ত এখনও প্রকাশিত হয়নি।
আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান টিবিএসকে বলেন, ডলারের দামের স্বচ্ছতার অভাব বাজারে মুদ্রাটির দাম বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ।
তিনি জানান, ডলারের দামের পাবলিক কোনো তালিকা না থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতারা দাম জানতে গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন। ব্যাংকগুলো নিয়মিত তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের হার বাংলাদেশ ব্যাংকে জানালেও এ তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও এর ওয়েবসাইটে ডলারের ১২০ টাকার অফিসিয়াল রেট দেখাচ্ছে, যদিও বাজারের গড় হার ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে রয়েছে।
প্রকাশিত এবং অনানুষ্ঠানিক দামের মধ্যে এ অসঙ্গতি বাজারের চাহিদায় ভুলভাবে প্রভাব ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন এ কর্মকর্তা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বছরের শেষদিকে ব্যাংকগুলো সাধারণত অর্থপ্রদানের চাপে থাকে।
তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকগুলোকে অভ্যন্তরীণ পরিশোধকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন।
তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক বিভিন্ন দামে ডলার কিনে গড় দামে বিক্রি করছে, যা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সরকারি এলসির অতিরিক্ত অর্থপ্রদানের চাপ এবং বকেয়া পরিশোধের নির্দেশের কারণে ডলারের দামে প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করে বকেয়া পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোও চাপের মধ্যে রয়েছে।
তবে একটি স্বাধীন বিনিময় হার ব্যবস্থা বাজারে শৃঙ্খলা আনতে এবং অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।