‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জিডিপি ৩০০ বিলিয়ন, ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার নয়’
সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস-এর প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপির আকার প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার, যা বিগত সরকারের ঘোষিত ৪৫৯ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক কম।
বিনিয়োগ ব্যাংকটির 'ম্যাক্রো ইকোনমিক আউটলুক ২০২৫' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিপরীতে অর্থনৈতিক উৎপাদনের তুলনা করে জিডিপির এই হিসাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যের বরাত দিয়ে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটালের বিশ্লেষকরা বলেন, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে মাত্র ৯৬ মিলিয়ন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়েছে, যা আঞ্চলিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম।
জিডিপির পরিমাণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তারা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বাংলাদেশ কীভাবে ভারত, পাকিস্তান বা চীনের চেয়ে ৫০-৬০ শতাংশ বেশি অর্থনৈতিক উৎপাদন দেখাতে পারে?
বাংলাদেশের জিডিপির হিসাব নতুন করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সিটি ব্যাংক ক্যাপিটালের কর্পোরেট অ্যাডভাইজরি ও রিসার্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল্লাহ আল ফয়সাল বলেন, বিগত শেখ হাসিনা সরকার রপ্তানি ও জিডিপিসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সেবা খাত বা উচ্চমূল্যের উৎপাদন খাত এমন ব্যতিক্রমী কোনো অবদান রাখছে না, যা জিডিপিকে এত বাড়িয়ে তুলবে।
আবদুল্লাহ আল ফয়সাল বলেন, দেশের সেবা ও উচ্চমূল্যের উৎপাদন খাত সাধারণত অর্থনৈতিক উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে যথাক্রমে ৪ শতাংশ ও ৫.১ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থা দুটির পূর্বাভাসের বরাত দিয়ে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের ঋণ, সংকোচনমুখী রাজস্ব ও মুদ্রানীতির কারণে প্রবৃদ্ধি আরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে অপর্যাপ্ত অর্থায়ন এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে এখনই স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ ঘটলে জরুরি সহজ শর্তের অর্থায়ন ও বাণিজ্য সুবিধা কমে যাবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, আরও স্থিতিশীল ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন স্থগিত রাখার বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত।
সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল বলেছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৩৬.৪৩ শতাংশ বলে যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, জিডিপির পরিমাণ নতুন করে হিসাব করা হলে তা ৫৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এছাড়া জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের হারও ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের সরকারের নেওয়া উচ্চ ব্যয়ের প্রকল্পগুলো ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। কিন্তু এসব বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন কম আসায় ভবিষ্যতে এউ ঋণ পরিশোধ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। আর্থিক সংকট এড়াতে বিচক্ষণ আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদের দক্ষ ব্যবহার অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও টাকার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক লক্ষণ।
সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকৃত রপ্তানি আয় ৪৪.৫ বিলিয়ন ডলার হবে—যা বিগত সরকারের প্রাক্কলনের চেয়ে ১০ বিলিয়ন ডলার কম। তবে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
প্রথম চার মাসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ৯.০৪ শতাংশ বেড়েছে, যা উৎপাদন খাত বিশেষ করে রপ্তানি খাতে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সিটি ব্যাংক ক্যাপিটালের বিশ্লেষকরা আরও বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ব্যাংকগুলোর অপ্রদর্শিত দুর্দশাগ্রস্ত সম্পত্তিগুলো যথাযথভাবে রিপোর্টিংয়ের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে মার্চের পর শিল্প খাতের খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তারা বলেন, চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। জুলাই-নভেম্বর সময়কালে রেমিট্যান্স প্রবাহে ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের নিট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ জিডিপির মাত্র ০.৩ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এর সঙ্গে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ঋণের চড়া সুদহার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল বলেছে, গত কয়েক বছরে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার পর ২০২৫ সালে ডলারের অফিশিয়াল দর ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১২৭ টাকায় উঠতে পারে। খোলাবাজারে ইতিমধ্যেই ডলারের দাম ১২৬ টাকা ছুঁয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে একইসঙ্গে চলতি হিসাবের ঘাটতি ও বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন।