কর্মীদের রোবট ভীতি: যন্ত্র কি আমার চাকরি কেড়ে নেবে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের আবির্ভাবে সূচনা হতে চলেছে নতুন যুগের। এতে শ্রমবাজারেও প্রযুক্তিগত বিপ্লব সংগঠিত হতে যাচ্ছে। আর এটি হতে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে, যা শঙ্কা বাড়িয়েছে কর্মীদের। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে- এটি কি কাজের বিদ্যমান পরিবেশকে আসলেই বিপদে ফেলবে?
কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলছেন, মেশিন বা যন্ত্রের বিকাশ নিয়ে ভয়ের কারণ নেই। বরং তারা এটিকে প্রযুক্তির আরেক ধাপ অগ্রগতি হিসেবেই দেখছেন, যা অনেক বেশি সক্ষমতার কারণে কাজ করার পদ্ধতি নতুনভাবে নির্ধারণ করবে। তবে অনেকে বলছেন, এর কারণে সবকিছু বদলে যাবে।
উদাহরণস্বরূপ, শ্রম আইনজীবীরা মনে করেন, জনশক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কর্মক্ষেত্রের নতুন অ্যালগরিদমগুলো সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। তাদের ভয় হলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কর্মীদের স্বাস্থ্যসহ মানবিক বিষয়গুলো গুরুত্ব হারাতে পারে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা এসব পরিবর্তনকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন, যা কাজের প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে, খরচ কমাতে এবং কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে অনেক কর্মীই ভয় পাচ্ছেন যে নতুন এই পরিস্থিতির জন্য নিজেদের দ্রুত উপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারলে, তারা চাকরি হারাতে পারেন।
প্রযুক্তির এই অগ্রগতি ইতিমধ্যেই কাজের ক্ষেত্রে নিত্য-নতুন পদ্ধতি হাজির করেছে, যা বিভিন্ন শিল্পে দৃশ্যমান। যদিও মানুষ এবং মেশিন পাশাপাশি কাজ করছে, তবে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস অনুযায়ী, প্রযুক্তির এ অগ্রগতির কারণে অনেক কাজের ধরন সম্পূর্ণ বদলে যাবে। কারণ প্রগতির চাকা নীরবে এবং নিরলসভাবে সামনে এগিয়ে চলছে।
প্রযুক্তি মানবতাকে শীর্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে ঠিকই, তবে এখন এটি তার স্রষ্টাদের জন্যই দ্বিমুখী ধারালো তলোয়ার হয়ে ওঠার হুমকি তৈরি করেছে।
স্পেনের মালাগা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অটোমেশন বিভাগের অধ্যাপক ও পরিচালক আলফোনসো গারসিয়া বলেন, 'বর্তমান যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জামগুলো (টুল) খুব শক্তিশালী এবং একইসঙ্গে উপকারী। এগুলো প্রধানত সেই বিরক্তিকর কাজগুলো করবে, যেগুলো অনেক কর্মীকে রোবট বানিয়ে ফেলে। প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসের বিপরীতে এআই আসলে কাজকে মর্যাদা দিতে এসেছে।
গারসিয়ার মতে, এআই-চালিত যন্ত্রপাতির এ সক্ষমতা একদিনে অর্জন হয়নি। এটি বহু বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল। এআইয়ের তাত্ত্বিক ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নাটকীয়ভাবে এর বিবর্তন ঘটেছে।
গুণগত ধাপ বা পরিবর্তন
এআইয়ের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তির চলমান অগ্রগতি আরও বড় এক মাইলফলকে পৌঁছেছে। এআই বাস্তবের মতোই অবিকল ছবি, লেখা, সঙ্গীত ও ভিডিওসহ বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। এআইয়ের নতুন এ সক্ষমতার আবির্ভাব গত বছরে হলেও খুব অল্প সময়েই এটি কর্মক্ষেত্রে জনশক্তির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে এবং অনেক কর্মীর কাছেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা একাধিক জরিপ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের তথ্যমতে, ৪২ শতাংশ স্প্যানিশ কর্মী উদ্বিগ্ন এটা ভেবে যে আগামী দশকের মধ্যে এআই হয়ত তাদের জায়গা দখল করে নেবে। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ, কর্মীদের উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে।
যারা এআই টুলের সক্রিয় ব্যবহারকারী, তারা এর সক্ষমতা সম্পর্কে বেশি অবগত। আর এ কারণে চাকরি হারানোর ভয়টা তাদের মধ্যেই বেশি। তবে তাদের কি আসলেই চিন্তার কারণ আছে?
স্পেনের মাদ্রিদে অবস্থিত কার্লোস থ্রি ইউনিভার্সিটির মাস্টার ইন অ্যাপ্লাইড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপপরিচালক আগাপিতো লেদেজমা বলেছেন, প্রশ্ন এটা নয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জায়গা দখল করে নেবে কি না, বরং প্রশ্ন হলো কখন এমনটা হতে পারে। আর এ প্রশ্নের কারণ হলো এটা অবশ্যই ঘটবে। এখন তো সবে শুরু। যখন এআই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে, তখন আমরা কেবল এটিকে চালু করব এবং এটি কাজ শুরু করবে।
প্রতিটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানই কম সময়ে বেশি কাজ সম্পন্ন করা বা বেশি উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তির উৎকর্ষকে কাজে লাগাতে চায়। আর এটি ছোট কোম্পানিগুলোর জন্য আরও বেশি প্রয়োজনীয়।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ইতোমধ্যেই ৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানি এসব টুল বা যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে। ক্যামব্রিজ ভিত্তিক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি হাবস্পটের গবেষণা অনুযায়ী, ব্যবসার পরিধি বাড়াতে স্পেনের ৬৬ শতাংশ কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রমে এআই যুক্ত করেছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কোম্পানির কাছে এআই তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় 'মুখ্য' হয়ে উঠেছে।
স্প্যানিশ অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সিকিউটিভসের (এইডি) জেনারেল ডিরেক্টর জেভিয়ার গ্যাংগোনেলস বলেন, এখন কোম্পানিগুলো উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এবং ডেটার ভাল ব্যবহারের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী। তবে খুব শীঘ্রই আমরা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাবো, যা কোম্পানির কাঠামোতে কম প্রভাব ফেলবে। তবে বেশি প্রভাব ফেলবে এসব কোম্পানির তৈরি এবং সরবরাহ করা পণ্য ও সেবাগুলোর ওপর। আমরা ইতিমধ্যে এমন কিছু উদাহরণ দেখতে পাচ্ছি, যেখানে উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ভালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেবার অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি ল-এর অধ্যাপক আদ্রিয়ান টোদোলি সতর্ক করে বলেছেন, 'প্রযুক্তির মানুষের জায়গা দখলের সম্ভাবনার পেছনে কিছু হুমকিও রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপদটি হলো, এগুলো আপনার বেতন কেড়ে নেবে।'
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মাস দুয়েক আগে এআই অ্যাক্ট কার্যকর করা হয়। এ আইনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকির স্তর বিবেচনা করে ঝুঁকিকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। যথা- সর্বনিম্ন ঝুঁকি, নির্দিষ্ট ঝুঁকি, উচ্চ ঝুঁকি ও অগ্রহযোগ্য ঝুঁকি।
কর্মক্ষেত্রের ওপর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ বিশদভাবে পর্যালোচনা করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসেমোগলু ও পাসকুয়াল রেস্ত্রেপো। তারা মার্কিন শ্রম বাজারের ওপর রোবট ব্যবস্থার প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণাপত্র 'রোবটস অ্যান্ড জবস: এভিডেন্স ফ্রম দ্য ইউএস লেবার মার্কেটস'-এ তারা বলছেন, ১৯৯৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে শ্রমবাজারে যুক্ত করা প্রতিটি নতুন রোবটের কারণে ছয়জন তাদের চাকরি হারিয়েছেন এবং শ্রমিকদের বেতন এক শতাংশ করে কমেছে।
নিউ টেকনোলজিক্যাল ট্রেন্ডস বিশেষজ্ঞ এবং অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সিলভিয়া লিয়াল জানান, অনেকেই এটা মনে করেন যে এআইয়ের কারণে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারাবে। তবে সত্যটি হলো, এসব নতুন টুলের ব্যবহার বা পরিচালনার জন্য অসংখ্য মানুষের প্রয়োজনও হবে।
বৃহৎ বাজার
বর্তমানে এআই প্রযুক্তির কল্যাণে অর্থনীতি যে দ্রুত বাড়ছে, তা অনস্বীকার্য। জার্মান পরিসংখ্যান পোর্টাল স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী এআই বাজারের মূল্য প্রায় ২০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিশাল বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিশ্বজুড়ে এআই টুলগুলোর দ্রুত বিস্তার।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসি-এর গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৭৩ শতাংশ কোম্পানিই ইতোমধ্যে তাদের ব্যবসার কোনো না কোনো দিক দিয়ে এআই ব্যবহার করছে।
তবে এখন প্রশ্ন হলো- নির্দিষ্ট কিছু কাজ এআইয়ের ওপর ছেড়ে দিতে কি কর্মীরা প্রস্তুত? এ বিষয়ে এলএইচএইচ রিক্রুটমেন্ট সলিউশনস (অ্যাডেকো গ্রুপ)-এর টেকনলোজি ডিরেক্টর প্যাট্রিসিয়া জামাকোলা বলেন, আমাদের এমন কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, যারা ব্যবসার লজিক ও কাজের কোন অংশটুকু মানুষেরই করতে হবে এবং কীভাবে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হবে, তা বুঝতে সক্ষম।
তিনি বলেন, 'যাতে আমরা হিসাবের বাইরে চলে না যাই, সেজন্য আমাদের প্রশিক্ষিত হতে হবে এবং নিজেদের বাজারের চাহিদা উপযোগী হিসেবে তৈরি করতে হবে।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক