ব্যাংক শেয়ারের মালিকানা হস্তান্তর, আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন আইন পাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক শেয়ারের মালিকানা পরিবর্তন, একীভূতকরণ, অবসায়ন ও অধিগ্রহণে নতুন একটি বিশেষ আইন করতে যাচ্ছে সরকার। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বেশকিছু ব্যাংকের মালিকানায় থাকার কারণে যে উদ্বেগ রয়েছে— সেই প্রেক্ষাপটেই এই আইন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অবহিত কর্মকর্তারা জানান, "ব্যাংক রেগুলেশন অ্যাক্ট" নামের এই বিশেষ আইনের খসড়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনটি পাস হলে ব্যাংক শেয়ারের মালিকানা হস্তান্তর, দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণে মালিকের অনুমোদন লাগবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন করলেই সেটা করা সম্ভব হবে। এছাড়া, ভবিষ্যতে পুরনো মালিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করলেও তা টিকবে না। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও সম্ভাব্য ক্রেতারা আইনি সুরক্ষা পাবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, "আইনটির খসড়া করা হয়েছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মতামত নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টেরও মতামত নেওয়া হবে। এরপর পাঠানো হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ স্টেকহোল্ডার মিটিং করবে। সেখানে দেশের ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধি, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত থাকবেন। খুব শিগগিরই এই মিটিং হবে।"
ব্যাংকের যেসব শেয়ারহোল্ডার/মালিক— যার শেয়ার সরকার ক্রোক করবে— সেটা ঋণ পরিশোধ বা কর পরিশোধ যে কারণেই হোক, অথবা তিনি ব্যাংকের মালিকানায় থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে, এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়টিও প্রস্তাবিত আইনে রাখা হয়েছে। এসব শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ দিয়ে প্রথমে দায়দেনা বা ঋণ শোধ করা হবে, তারপর উদ্বৃত্ত থাকলে সেটা তাদের হিসাবে জমা করা হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, "আইনটি খুব পরিস্কারভাবে করা হচ্ছে। ধরুন, এবিসি ও ডিইএফ নামের দুটি ব্যাংক মার্জ (একীভূত) করে এক্সওয়াইজেড নামের একটি ব্যাংক করা হলো। আগের দুটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ২০ জন করে মোট ৪০ জন পরিচালক ছিলেন, কিন্তু নতুন ব্যাংকে তো ৪০ জন পরিচালক রাখা যাবে না। সেজন্য কে, কেন, কীভাবে বাদ পড়বেন— সেগুলো এই আইনে স্পষ্টভাবে থাকছে।"
"আবার যদি নতুন ব্যাংক না করে, একটি ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সাথে মার্জ করা হয়— তাহলে সেখানে মার্জ হওয়া ব্যাংকের পরিচালকদের কার কতটা শেয়ার থাকবে বা কে পর্ষদে থাকবে— সেগুলোও বলা হয়েছে আইনের খসড়ায়" -- যোগ করেন তিনি।
নতুন আইনের উদ্দেশ্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে ওই সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা নিয়েছে। এই মালিকানা নেওয়ার ক্ষেত্রে, জাল-জালিয়াতি ও জোর করে শেয়ার হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এসব ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ঋণ অনিয়ম করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্তে উঠে এসেছে। তাঁদের অনিয়ম, দূর্নীতির কারণে ব্যাংকগুলো এখন গভীর সংকটে।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে— বাংলাদেশ ব্যাংক আগের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নতুন করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে কমপক্ষে ১০টি সংকটে থাকা বেসরকারি ব্যাংকে। এরমধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক রয়েছে। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ও এক্সিম ব্যাংকের-ও পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হলেও – মালিকানায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। প্রথমত এসব ব্যাংকের মালিকানায় যারা রয়েছেন— তাদের বড় অংশের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অন্যদিকে এসব মালিকদের বেশিরভাগ পলাতক বা বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় বন্দি। ফলে মালিকের অনুপস্থিতিতে বা অনুমোদন ব্যতিরেকে সরকার যাতে শেয়ার ট্রান্সফার (হস্তান্তর) করতে পারে, সেজন্য এই বিশেষ আইন করা হচ্ছে।"
গত বছরের অক্টোবরে কর প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের আমলে বিশেষ সুযোগ পাওয়া এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপসহ সাত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর শেয়ার স্থানান্তর (কেনা-বেচা ও দান) বন্ধ করতে যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরকে (আরজেএসসি) নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বর্তমানে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর মালিকানা এসব গ্রুপের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে।
মালিকানায় পরিবর্তন ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান কাজ করবে
ব্যাংকখাত সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "দুর্বল ব্যাংকের মার্জার, অধিগ্রহণ, অবসায়ন করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে দুর্বলতা আছে। তাই ব্যাংক রেগুলেশন অ্যাক্ট নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।"
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এই আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পৃথক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, যারা দুর্বল ব্যাংকগুলোর শেয়ারের মালিকানা পরিবর্তন, একীভূতকরণ, অবসায়ন, বা অধিগ্রহণ বিষয়ে কাজ করবে। আইনটি এমনভাবে করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোন পুরানো মালিক আদালতে মামলা করেও তার মালিকানা ফেরত পেতে না পারেন; কিংবা নতুন মালিককে বিপদে ফেলতে না পারেন। এটি নিশ্চিত করা না গেলে, কেউই প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকদের শেয়ার বা মালিকানা কিনতে আগ্রহী হবে না।
আমানতকারীদের সুরক্ষায় পৃথক আইন
জাহিদ হোসেন বলেন, কোন ব্যাংক বিলুপ্ত করতে গেলে— আমানতকারীদের স্বার্থের বিষয়টি আগে দেখতে হবে। বিদ্যমান আমানত সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, আমানতকারীরা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ডিপোজিট ফেরত পাবেন। কিন্তু কোন ব্যাংকে যাদের আমানতের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি, তাদের কী হবে? তাই সকল আমানতকারীদের বিমা সুবিধার আওতায় আনা, এবং কোন অবস্থায় তাঁদেরকে কতোটা কাভারেজ দেওয়া হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে নতুন একটি আমানত বিমা আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পর্যালোচনা করা হচ্ছে। খেলাপি ঋণের মধ্যে কতো টাকা আদায় করা সম্ভব হবে – সেগুলো নির্ধারণের পর দুর্বল ব্যাংকগুলোর মালিকানা বদল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।