হাসিনার পতনের পর পুঁজিবাজারে সক্রিয় হয়েছিলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, এখন তুলে নিচ্ছেন বিনিয়োগ
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাময়িকভাবে দেশের পুঁজিবাজারে সক্রিয় হলেও, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা তাদের বিনিয়োগ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন।
শুরুর দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সম্ভাব্য সংস্কারের আশায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আশাবাদ দেখা গিয়েছিল, যা বাজারে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে তোলে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের প্রথমার্ধে তার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন ৫০১ শতাংশ বেড়ে ৪০৪.৮২ কোটি টাকায় পৌঁছায়। পুরো মাসজুড়েই এ ইতিবাচক ধারা বজায় ছিল। ওই মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মোট লেনদেন দাঁড়ায় ৮১২ কোটি টাকায়, যার মধ্যে ৫৬৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয় এবং ২৪৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি হয়।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরেও ক্রয়ের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেপ্টেম্বর মাসে ১৭০ কোটি টাকার শেয়ার কেনেন এবং ১৬৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেন। অক্টোবর মাসে তারা ১২৩ কোটি টাকার শেয়ার কেনেন এবং ৩৪ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেন।
তবে, আগের সরকারের সময়ে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলোর কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও গভীর হয়। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশাবাদ ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করে।
নভেম্বর মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১৬৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনেন এবং ২০০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেন, যার ফলে নিট ৩৫ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলন ঘটে। ডিসেম্বর মাসে ৯৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির বিপরীতে ৭৩ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়, যার ফলে ২৩ কোটি টাকার নিট উত্তোলন দেখা যায়।
দৈনন্দিন বাজার তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসেও বিদেশি বিনিয়োগে কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি।
'আত্মবিশ্বাসে ভাটা'
ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের 'আত্মবিশ্বাস কমে গেছে', তার সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এ চ্যালেঞ্চ আরও বাড়িয়েছে।
তিনি জানান, পুঁজিবাজার সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে এবং এটি চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চেয়ারম্যান আরও বলেন, "ভালো মানের শেয়ারগুলো এখন অবমূল্যায়িত। সংস্কার সম্পন্ন হলে এবং অর্থনীতি স্থিতিশীল হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসবে।"
তিনি উল্লেখ করেন, অনাবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে নতুন পণ্য আনার পরিকল্পনাও রয়েছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, আগের সরকারের পতনের পরপর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার ক্রয়ে কিছুটা সক্রিয়তা দেখা যায়।
তবে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনর্নির্মাণে এখনও উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে তারা এখনো সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
সাইফুল আরও বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজার সংস্কার এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।"
২০২৪ সালে বৈদেশিক লেনদেন
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন কার্যক্রম ২০২৩ সালের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে, তারা শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ক্রয়ের তুলনায় বেশি রেখে বাজার থেকে নিট বিনিয়োগ কমিয়েছে।
২০২৪ সালে ডিএসইতে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৫.২৮ শতাংশ বেশি। গড় দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩২ কোটি টাকায়।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের মোট পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৬৩৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ২০২৩ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবে, তারা এক হাজার ৯৫৫ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে এক হাজার ৬৮৩ কোটি টাকার শেয়ার কেনে, যার মাধ্যমে এ বিনিয়োগকারীরা ২০২৪ সালে বাজার থেকে ২৭১ কোটি টাকার নিট মূলধন প্রত্যাহার করে।
সাময়িক উত্থান
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ডিএসইতে টার্নওভার এবং সূচক উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। মাত্র চারটি ট্রেডিং সেশনেই বেঞ্চমার্ক সূচক ৭৮৬ পয়েন্ট বাড়ে এবং ১১ আগস্টে ডিএসইএক্স ছয় হাজার ০১৫ পয়েন্টে পৌঁছায়।
কিন্তু, ধারাবাহিক শেয়ার বিক্রি এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কিছু পরিবর্তনের কারণে বাজারে পতন শুরু হয়। ২৭ অক্টোবরের মধ্যে ডিএসইএক্স পাঁচ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যায়।
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) পর্যন্ত সূচক পাঁচ হাজার ২০২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদহার এবং ক্রমবর্ধমান ইউটিলিটি খরচ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসাগুলো উচ্চ ব্যয়, বর্ধিত মজুরি এবং অন্যান্য আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিপাকে পড়েছে। মঞ্জুর সরকারকে এসব সমস্যা সমাধান করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ একসময় কম খরচের কারণে বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ব্যয় বিনিয়োগকারীদের ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বলেন তিনি।
১৮ জানুয়ারি এক আলোচনায় মঞ্জুর বলেন, "আমার ৩৪ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হইনি।"
সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ সর্বনিম্ন
২০২৪ সালে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা ২০১০ সালের পর সর্বনিম্ন। এ হার অন্যান্য সমকক্ষ দেশের তুলনায়ও অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে থাইল্যান্ডে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ছিল ৫১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩৩ শতাংশ, ফিলিপাইনে ২৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১৮ শতাংশ, ভারতে ১২ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৪ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশ এ তালিকার একেবারে নিচে অবস্থান করছে।
ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের সিইও আহসানুর রহমান বলেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উন্নত সুশাসন এবং সুষ্ঠু নীতিমালা কার্যকর হবে বলে আশা করেছিলেন।
তিনি বলেন, এ আশাবাদ দেশীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীর তৎপরতা বাড়িয়েছিল, যা ট্রেডিং ভলিউম এবং সূচকের প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
"তবে, এ উৎসাহ দ্রুত ম্লান হয়ে গেছে," বলেন তিনি। "বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও দুর্বল ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতের প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা মূলধন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শেয়ার বিক্রি করে সরে দাঁড়িয়েছে।"
ডিএসইর বাজার পরিস্থিতির প্রতিবেদন
২০২৪ সালের জুনে ডিএসইর বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও স্থানীয় অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে বাজার ক্রমাগত মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এ অবস্থার প্রভাব স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ওপরেও পড়েছে। সরকারি সিকিউরিটিজে উচ্চ রিটার্ন এবং ঋণের উচ্চ সুদের হার তহবিল সংগ্রহের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট এবং বৈশ্বিক আর্থিক নীতিমালার কড়াকড়ি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রমেও বাধা সৃষ্টি করেছে।
ফলে দেশীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা ২০২৪ সালে বাজারের ৯৯.১২ শতাংশ টার্নওভার নিশ্চিত করলেও, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশ ছিল মাত্র ০.৮৮ শতাংশ।
বাজারের পূর্ববর্তী প্রবণতা
২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় বৃদ্ধি করে পাঁচ বছরের শেয়ার বিক্রির ধারা উল্টে দিয়েছিল। তারা সে বছর এক হাজার ১১৫ কোটি টাকার শেয়ার কিনে এক হাজার ৫০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছিল, যার ফলে নিট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছিল ৬৪ কোটি টাকা।
তবে, ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ধারাবাহিকভাবে বাজার থেকে মূলধন তুলে নিয়েছিল। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ বিদেশি লেনদেন রেকর্ড করা হয়েছিল ১১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গ্রামীণফোনে বিদেশি মালিকানার পরিমাণ ১.৫৮ শতাংশ থাকলেও, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তা কমে ০.৯৮ শতাংশে নেমে আসে। রেনাটা পিএলসি-তেও একই চিত্র দেখা গেছে—২০২৩ সালে ২২.২৩ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ২১.১৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
বড় বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে ভূমিকা
একটি ব্রোকারেজ হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর নতুন কমিশন বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। কারসাজি দমনে কঠোর জরিমানা আরোপ এবং বাজারের নিয়ন্ত্রণ আনতে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
তিনি বলেন, তবে, এ পদক্ষেপগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে তাদের শঙ্কিত করে তোলে। বড় বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে চলে যায় এবং এর ফলে বাজার আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও পিছিয়ে দিচ্ছে।
"সংস্কার সম্পূর্ণরূপে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাজারের গতি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম," তিনি বলেন। কোম্পানিগুলো তাদের ছয় মাসের আয় প্রকাশের পরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন শেয়ার কিনতে আরও সক্রিয় হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।