দীর্ঘ অসন্তোষের পর যেভাবে ধকল কাটিয়ে উঠছে আশুলিয়ার কারখানাগুলো
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/07/p_3-highlight-copy.jpg)
ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়ার কারখানাগুলো থেকে অর্ডার কমাচ্ছে বেশিরভাগ স্বনামধন্য পোশাক ব্র্যান্ড ও রিটেইলাররা। গত বছরের শ্রমিক অসন্তোষের পর সরবরাহ চেইনের ঝুঁকি কমাতে এই পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেন, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডগুলো বিশেষভাবে সতর্ক। সম্ভাব্য বিঘ্ন এড়াতে তারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদন স্থানান্তর করছে।
এই পরিবর্তনে আশুলিয়ার সরবরাহকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন কৌশলে প্রভাব ফেলছে।
তবে কারখানা মালিকরা বলছেন, আশুলিয়া আপাতত ২০২৫-২৬ সালের বসন্ত-গ্রীষ্ম মৌসুমের জন্য চীন থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসা বাড়তি অর্ডার সামলাচ্ছে।
এতে তাৎক্ষণিকভাবে বড় ব্র্যান্ডগুলোর ফাঁকা জায়গা পূরণে সাহায্য হওয়ায় এ অঞ্চলের ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে আলাপকালে এসএম সোর্সিং-এর সিইও মির্জা শামস মাহমুদ শক্তি বলেন, 'ক্রেতারা ইতিমধ্যেই এই অঞ্চলের ঝুঁকি নিরূপণ করে তাদের অর্ডার পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি ম্যাপ তৈরি করেছে।'
তবে কমদামি ও ডিসকাউন্টে পণ্য নেওয়া ক্রেতারা মূল্য বিবেচনায় তাদের অর্ডার কমাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে এর পরও এ এলাকা পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি বলে সতর্ক করেছেন শিল্প নেতারা। তারা বলেন, আশুলিয়া ফের ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে পারবে কি না তা স্পষ্ট হবে মার্চের পর, রপ্তানিকারকরা যখন ২০২৬ সালের শরৎকালীন ছুটির মৌসুমের জন্য অর্ডার নিতে শুরু করবে।
ক্রেতাদের ফিরিয়ে আনতে শিল্প নেতারা শিল্প অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন।
কিছু কারখানা পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা বজায় রাখতে সাবকন্ট্রাক্টিং-এর ওপর নির্ভর করছে। তবে স্বনামধন্য ক্রেতাদের জন্য সাবকন্ট্রাক্টিংয়ের ক্ষেত্রে আগাম অনুমোদন নিতে হয়।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, আশুলিয়ায় ৪০০-রও বেশি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ১০ লাখ কর্মী কাজ করেন। দেশের বার্ষিক রপ্তানি আয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখে এ অঞ্চলের কারখানাগুলো।
মির্জা শামস আরও বলেন, আশুলিয়ার পর সাভার-জিরানী এলাকাও শ্রমিক অসন্তোষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রধান সড়কের পাশের কারখানাগুলো বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষ করে বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকরা এই অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। আর্থিক সমস্যার কারণে গ্রুপটির ইউনিট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পর কারখানাগুলো ফের চালু করার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছেন তারা।
গত বছর এসএম সোর্সিং ৮৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তাদের আশুলিয়ার কারখানা ম্যাঙ্গো টেক্স বার্ষিক ২২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করত।
তবে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে প্রায় ৪৫ দিন উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় গত বছর তাদের রপ্তানি ৪.৫ মিলিয়ন ডলার কমেছে।
এরপর প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে। আশুলিয়া থেকে অর্ডার সরে যাওয়া সত্ত্বেও কারখানাটি স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে, কারণ এখানে ডিসকাউন্ট রিটেইলারদের জন্য প্রচারণামূলক পণ্য উৎপাদন করা হয়।
শামস বলেন, 'ডিসকাউন্ট রিটেইলারদের সাথে কাজ করা চ্যালেঞ্জিং। কারণ তারা প্রতি বছর দাম কমানোর চেষ্টা করে। তবে রপ্তানিকারকদের উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে মানিয়ে নিতে হয়।'
তার কোম্পানি মে মাস পর্যন্ত পূর্ণ-সক্ষমতার অর্ডার বুক করায় চলতি বছর তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানির বিষয়ে আশাবাদী।
ব্যবসার সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তিনি বলেন, 'শিল্প অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা যদি স্থিতিশীল হয়, তবে পুরো খাতে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে।'
আশুলিয়া থেকে অর্ডার স্থানান্তর
পোশাক রপ্তানিকারকরা জানান, আশুলিয়ার কারখানাগুলোর জন্য নির্ধারিত অনেক অর্ডার এখন গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ যেসব অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম, সেখানকার কারখানায় সরানো হচ্ছে।
একজন শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'একটি স্বনামধন্য মার্কিন ব্র্যান্ড ইতিমধ্যেই আমাদের জানিয়েছে, তারা আশুলিয়াভিত্তিক কারখানায় উৎপাদন চালিয়ে যেতে চায় না।'
তারা তাদের পণ্য ওই গ্রুপেরই অন্য একটি অঞ্চলের কারখানায় উৎপাদনের অনুরোধ করেছে।
একই ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করা গাজীপুর অঞ্চলের একজন সরবরাহকারী বলেন, অর্ডার স্থানান্তরের ধাক্কা সামাল দেওয়ার জন্য ক্রেতার পক্ষ থেকে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর চাপ রয়েছে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'বেশিরভাগ স্বনামধন্য ক্রেতা আশুলিয়া অঞ্চল থেকে ঝুঁকি কমানোর পরিকল্পনা করছে।'
তিনি বলেন, গত বছরের অস্থিরতায় অনেক ক্রেতা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এখন তারা অর্ডার অন্যত্র সরানোর দিকে ঝুঁকছে।
'ক্রেতাদের তথ্যমতে, শীর্ষ ১০০ শতাংশ ক্রেতাই আশুলিয়ার সরবরাহকারীদেরকে তাদের অনুমোদিত তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিছু ক্রেতা ইতিমধ্যেই আশুলিয়ার বাইরে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে কারখানা খুঁজছে,' বলেন তিনি।
২০২৬ সালের শরৎকালীন ছুটির মৌসুমের জন্য মার্চ-জুলাই উৎপাদন সময়কালে পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরীও এই উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, 'আশুলিয়াভিত্তিক কারখানাগুলোর অস্থিতিশীলতা সময়মতো উৎপাদন এবং শিপমেন্টের লিড টাইম বজায় রাখতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ফলে ক্রেতারা চট্টগ্রামের কারখানাগুলোকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে।'
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
পোশাক রপ্তানিকারকরা বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে চীন থেকে বিপুলসংখ্যক অর্ডার স্থানান্তরিত হচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের সুরাহা করা না হলে বাংলাদেশ এই সুযোগগুলো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবে না।
টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, 'এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এবং ব্যবসা ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে সরকারকে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান বের করতে হবে।"
শোভন ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব রাখতে হবে।
'তবে আমরা লক্ষ করছি, সব নীতিই আরএমজি খাতকে চাপে ফেলছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা খুবই আশাবাদী যে সরকার যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করতে পারে, তবে পোশাক শিল্প অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।'