বাড়ছে না মানসম্পন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন
সীমিত জমিতে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বীজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও মানসম্পন্ন বীজের সরবরাহ এখনো চাহিদার চার ভাগের এক ভাগেরও কম। বেসরকারী খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসলেও রাষ্ট্রায়ত্ত বীজ উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) বীজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে খুব বেশি গতি নেই। গত ১১ বছরে প্রতিষ্ঠানটির বীজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩. ৭৮ শতাংশ।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসি সূত্র বলছে, বছরে বিভিন্ন ফসলে উৎপাদনে প্রায় ১৩ লাখ টন বীজের চাহিদা রয়েূছে। এই চাহিদা পূরণ করা হয় তিন ক্যাটাগরির বীজ দিয়ে। এর মধ্যে ফরমাল ক্যাটগরিতে বীজের সরবরাহ ২৩ শতাংশ। এই বীজগুলো নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিএডিসি ও বেসরকারী খাতের মাধ্যমে কৃষকের হাতে পৌঁছে। তবে ভালো মানের এসব বীজের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও ৫ বছরে উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য কোন প্রবৃদ্ধি নেই।
বাকি দুটি ক্যাটাগরি হলো সেমি ফরমাল ও ইনফরমাল। সেমি ফরমাল ক্যাটাগরির বীজের সরবরাহ হচ্ছে ৩৯ শতাংশ। যেখানে সামান্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও বেশিরভাগই থাকে এই তত্ত্বাবধানের বাইরে। এখানেও সরবরাহকারী মূলত বেসরকারী খাত ও কৃষকরা নিজেরাই।
বাকি ৩৮ শতাংশ বীজ আসে বেসরকারী খাত থেকে। সারাদেশের কৃষক উৎপাদিত ফসল থেকে সংরক্ষণ করে নিজের চাষের জন্য রাখে এবং একটা অংশ বিক্রি করে দেয়। এই বীজের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই।
বিএডিসির সদস্য পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বীজ উৎপাদনের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে। আমাদের যে জনবল থাকার কথা সেখানে ৪৬ শতাংশ কম রয়েছে। তারপরও আমরা সক্ষমতার বেশি কাজ করছি।"
অথচ কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ বছরে বিএডিসি বীজের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পেরেছে মাত্র ৩.৭৮ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০-২১ অর্থবছরে বীজ উৎপাদন করেছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫০২ মে. টন বীজ। যা ২০১০-১১ সালে ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫ মে. টন। এর মাঝে অবশ্য উৎপাদন কখনো কখনো কমে গেছে, আবার কখনো বেড়েছে।
বিএডিসি মোট চাহিদার মাত্র ১১.৫০ শতাংশ বীজ সরবরাহ করছে। যা আরও বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ করা বীজের মধ্যে আউশ, আমন ও বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, ডাল, তৈল, পাট, সবজি, মসলা সহ বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন করছে। বিএডিসি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় ধানের বীজ উৎপাদনে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইং এর প্রধান বীজতত্ত্ববিদ ড. মো. আকতার হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, "আমরা মানসম্পন্ন বীজের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এর উৎপাদন ২৫ শতাংশে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি।"
অন্যদিকে সবজির বীজ উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে লাল তীর। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর ১ হাজার টন সবজি বীজ উৎপাদন করছে, যেখানে বিএডিসি করছে মাত্র ১১৫ টন।
আবার হাইব্রিড জাতের প্রসারের কথা বলা হলেও সেটিতেও দখল মূলত বেসরকারী খাতের। বোরো মৌসুমে প্রায় ১৮ হাজার টন হাইব্রিড বীজ দিয়ে ধান চাষ করে কৃষক। সেখানে বিএডিসি মাত্র ১৩৬০ টন বীজ উৎপাদন করতে পেরেছে ২০২০-২১ অর্থবছরে। বাকি সরবরাহ এসেছে বেসরকারী খাতের হাত ধরে।
বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বলছে, দেশে ২১৮টি হাইব্রিড জাতের মধ্যে ২০৩টি হাইব্রিড প্রাইভেট সেক্টর দ্বারা নিবন্ধিত হয়েছে।
এ বিষয়ে এসিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এন্ড সিইও ড. এফ এইচ আনসারি বলেন, "হাইব্রিড বীজের ৯৫ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করছে বেসরকারী খাত। বেসরকারী খাত এখন বীজ উৎপাদনে অনেক বেশি গবেষণা করছে। যে কারণে সবজির বীজের মান ও সরবরাহে বেসরকারী খাত অনেক এগিয়ে।"
বাংলাদেশ সীড এসোসিয়েশনের (বিএসএ) তথ্য বলছে, বেসরকারী খাতের মধ্যে বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লাল তীর, ব্র্যাক, সুপ্রিম সীড, এসিআই, পেট্রোকম, আফতাব বহুমুখী ইস্পাহানি অ্যাগ্রো, মল্লিক সীড, ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বায়ার ক্রপ সায়েন্স ও সিনজেনটা বীজ উৎপাদন করছে।
বেসরকারী খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারী খাত গবেষণায় জোর দেয়ার কারণে উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে গতি এসেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে জাত এনে তা স্থানীয় আবহাওয়ার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। একইসঙ্গে জীবনকাল, ফলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে বেসরকারী খাত।