তথ্যপ্রযুক্তির নতুন বিপ্লব আসছে পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানে
সব মহল্লায় এমন কিছু দোকান থাকে যার পণ্য রকমারি। স্থানীয়দের চাহিদা মাফিক থাকে নানান সামগ্রী। নেই আহামরি চাকচিক্য, সাদামাটা দোকানগুলো যারা চালান তারা গণ 'চাচা, মামা, ভাই' ইত্যাদি সম্বোধনের অধিকারী। পাওয়া যায় শ্যাম্পু, সিগারেট, গুড়ো দুধ থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্সও।
কোণে কোণে অবস্থান বলেই হয়তো এদের বলে কর্ণার স্টোর। ছোট উদ্যোক্তা বা একই পরিবারের সদস্যদের চালানো বিপণীগুলো দশকের পর দশক ধরে একইভাবে পরিচালিত হচ্ছে। হিসাবের পুরোনো খেরোখাতায় চলে লাভ-লোকসান, বাকি-নগদের অঙ্ক।
তবে স্থানীয়দের সাথে পরিচয়-পরিচিতির সুবিধা পায় এসব ব্যবসা। গৃহস্থালির বাজার-সদাই ফোনে অর্ডার দিলে, দোকানের মালিক বা কর্মচারীই তা ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দেন।
মুঠোফোন সেবা প্রসার এবং স্মার্টফোন ক্রমে সস্তা হয়ে ওঠায়- কর্ণার স্টোর নিয়ে নতুন উৎসাহের জোয়ার বইছে তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বে।
হবেই বা না কেন, আপাতদৃষ্টির সাদামাটা এসব উদ্যোগ যে বিপুল সম্ভাবনায় ভরপুর। তাদের অর্থনৈতিক অবদানও কোনো অংশ কম নয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে। এখানে অভিজাত এলাকার বাইরে পশ্চিমা ধাঁচের মুদি দোকান তেমন নেই। তাই মাসকাবারি বা হপ্তাহের কেনাকাটায় সর্ব-সাধারণের ভরসা 'ভাই/চাচা'র দোকান।
ভারতে এমন দোকানের নাম কিরানা। দেশটির ভোক্তারা মোট কেনাকাটার ৭০ শতাংশ সারেন কিরানায়। আরেক জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ায় এর নাম ওয়ারাংস, যেখানে মোট মুদিপণ্য ক্রয়ের ৮০ শতাংশ হয়। আর বৈশ্বিকভাবে কর্ণার স্টোর ব্যবসার মূল্য ৯০ হাজার কোটি ডলার।
তাই এখাত তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের নজরে মহল্লার দোকানটি আটপৌরে হলেও, সেদিকে তাকিয়ে শুধু ডলার চিহ্নই দেখছে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো।
বিগত কয়েক বছর ধরে অনেক স্টার্টআপ কোম্পানি এসব খুচরা বিক্রেতা দোকানকে ডিজিটাল মাধ্যমে ক্ষুদ্র সরবরাহ হাব হিসেবে গড়তে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই ব্যবসায় নেমে শত কোটি ডলার বাজারমূল্য অর্জন করেছে এমন স্টার্টআপের সংখ্যা এখন কয়েক ডজন।
মিশরে অ্যাপের মাধ্যমে হরেক পণ্য কিনে তাক ভরানোর সুযোগ পাচ্ছেন দোকানিরা। নাইজেরিয়ায় দোকানগুলো অর্থ লেনদেনে ছদ্ম-ব্যাংক হয়ে উঠেছে। চীনে ক্রেতারা কর্ণার স্টোর থেকে মুদিপণ্য কিনছেন অনলাইনে।
প্রযুক্তি জায়ান্টরাও ভীষণ তৎপর। অ্যামাজন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস সম্প্রতি ইন্দোনেশীয় স্টার্টআপ- উলা'য় করেছেন বিনিয়োগ। মুদিপণ্য সরবরাহের প্লাটফর্মটিতে এপর্যন্ত যুক্ত হয়েছেন ৭০ হাজারের বেশি খুচরা দোকানি।
স্টার্টআপগুলোর প্রযুক্তি এরমধ্যেই ব্যবহার করছে কয়েক কোটি দোকান। তবে তা সীমিত পরিসরে। পাড়া-মহল্লার দোকানে প্রযুক্তি বিপ্লব কেবল যাত্রা শুরু করেছে। এখনও উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায় অমিত সম্ভাবনা।
সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে এ খাত পরিণত হবে নিজস্ব এক শিল্পে। ফলে পশ্চিমা দেশের তুলনায় অনন্য এক ঘরানার ব্যবসা গড়ে উঠবে উন্নয়নশীল দেশে। পশ্চিমে যেমন প্রযুক্তি কোম্পানি খুচরা বিক্রিবাট্টার বিপণীর অবসান ঘটাচ্ছে, তার বিপরীতে এখাতের সাথে সহাবস্থানের মাধ্যমেই নিজের ভবিষ্যত নির্মাণ করবেন উন্নয়নশীল দেশের ছোট দোকানিরা।
এই সহাবস্থান কতদূর এগোবে সম্পূর্ণ বিষয়টি তার ওপরই নির্ভরশীল।
বাজার অভিজ্ঞতা, পণ্য পরিবেশনের দক্ষতা:
আদতে খুচরা দোকানকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পাইকারি বিক্রেতা, পণ্য উৎপাদক এবং ক্রেতার সাথে যুক্ত করার উদ্যোগগুলি বেশ আগে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু, প্রযুক্তির অন্যান্য খাতের মতোই এখানে স্ফীতি এসেছে মহামারিকালে।
লকডাউনের পাল্লায় যখন চলাফেরার উপায় রুদ্ধ; তখনই বাসাবাড়িতে মালসামান ডেলিভারির চাহিদা বাড়ে। মহল্লার বিশ্বস্ত দোকান থেকেই তা কিনতেই স্বাচ্ছন্দ্য দেখা গেছে ভোক্তাদের। কারণ এতে নিত্যপণ্য পাওয়া যায় দ্রুত। ক্রেতা-বিক্রতার ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কও আরেক চালিকাশক্তি।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই চাহিদা বুঝেই এগিয়ে আসে বিভিন্ন অ্যাপ নিয়ে। ফলে দোকানিরা যেমন অপেক্ষাকৃত কম টাকায় পণ্য কিনতে পারছেন, তেমনি তা বিক্রিও করতে পারছেন বেশি মুনাফায়।
তারা শুধুই নিজ পণ্যের চালান দেন এমন নয়। বরং অনলাইন প্লাটফর্মে স্থানীয় ক্রেতার দেওয়া অর্ডারের নানাবিধ পণ্য পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে মূল কোম্পানি থেকে ডেলিভারি চার্জ পাচ্ছেন। অনেক দোকানই হয়ে উঠেছে এমন মিনি ডেলিভারি হাব। বাড়তি আয়ের নতুন খাত পেয়ে উদ্দীপ্ত দোকানিরাও।
প্রযুক্তি কোম্পানিও এতে পাচ্ছে দারুণ সুবিধা। এতে নেই ভোক্তার ঠিকানা ভুল করার ঝুঁকি। কমেছে সরবরাহ অবকাঠামোর ব্যয়। এলাকাভিত্তিক হরেক পণ্যের বাজার চাহিদা সম্পর্কে তারা খুচরা দোকানিদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও পাচ্ছে মুফতে।
গেল সেপ্টেম্বরে এ ধরনের একটি স্টার্টআপ- শপআপ বাংলাদেশে সাড়ে ৭ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করে। বাংলাদেশে নয়া প্রযুক্তি উদ্যোগে এটাই তহবিল সংগ্রহের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
তাদের প্রধানতম মূলধন যোগানদাতা ছিল ভারতের সিকোইয়া ক্যাপিটাল ইন্ডিয়া। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মটি এপর্যন্ত পাঁচটি কর্ণার স্টোর নব-উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিক আনন্দ বলেন, "এই অঞ্চলে (ভারতীয় উপমহাদেশে) রয়েছে কোটি কোটি ছোট দোকান। তারা অর্থনীতির মেরুদণ্ড।"
সত্যিকার অর্থেই পাড়ামহল্লার এই দোকানগুলো সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। স্থানীয়দের সামর্থ্য অনুযায়ী পণ্য পরিবেশনেও তারা অদ্বিতীয়।
সব মিলে তারা নতুন প্রযুক্তি উদ্যোগের খরচ কমাতে রাখতে পারে বিশাল ভূমিকা। তাই সকল পক্ষই এখানে সুবিধাভোগী।
উন্নয়নশীল বিশ্বে ফোর-জি নেটওয়ার্কের ক্রম বিস্তারও রাখছে সহায়ক অবদান। সাথে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবসাকে করছে সহজতর।
প্রযুক্তির মূল ধারায় যুক্ত হয়ে অনেক দোকানিই এমন অভিনব পণ্যের সন্ধান পাচ্ছেন, যার বিপুল চাহিদা রয়েছে তার মহল্লায়। ফলে স্টার্টআপ কোম্পানিও উৎপাদকদের থেকে কমিশন আয় বাড়াতে পারছে। লাভ থেকে প্রেরণা নিয়েই তারা একের পর এক অ্যাপ সেবা আনছে। খেরোখাতার হিসাব এখন আধুনিক পদ্ধতিতে স্মার্টফোনেই সেরে ফেলা শিখছেন বহু দোকানি।
চীনে 'কমিউনিটি গ্রুপ বায়িং' নামক এক ব্যবসা মডেলে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে স্থানীয় টেক জায়ান্টরা। এই ব্যবস্থায় ভোক্তারা উইচ্যাটে যে পণ্যের অর্ডার দেন- তা পৌঁছে দেওয়ার ভার পান ভোক্তার কাছাকাছি ঠিকানার কোনো দোকানদার। ডেলিভারিতে কোনো ভুল হলে তার দায়ও দোকানিকে বহন করতে হয়। ফলে স্টার্টআপ কোম্পানির সুনামহানির ঝুঁকি অনেকখানি কমে গেছে।
নাইজেরিয়ার মতো যেসব দেশে ব্যাংক শাখার ঘাটতি; সেখানে মহল্লার দোকান দিচ্ছে আর্থিক সেবার সুযোগ। মিনি আর্থিক হাব হয়ে ব্যাংকিং সেবাকে সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে তারা।
মোবাইলে এজেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশেও বিপুল জনপ্রিয়। ছোট দোকানিরাও অন্যান্য পণ্যের সাথে সাথে দিয়ে চলেছেন এর সেবা।
উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ:
ভারতে হাজার হাজার কর্ণার স্টোরের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে অ্যামাজন। তাদের লক্ষ্য পণ্য মাঠপর্যায়ে মিনি-ফুলফিলমেন্ট সেন্টার গড়ে তোলা। এমন সেন্টারে অর্ডার করা পণ্যের মজুত থাকে, পরে সেখান থেকে তা পৌঁছে দেওয়া হয়। এপর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার দোকান তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকায় একই ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে কোকাকোলা। তবে তা প্রধানত মহল্লায় খাবার ডেলিভারির।
দোকানের হিসাবপাতির সুবিধা দিতে চারি অ্যাপ এনেছেন মরোক্কোর এক উদ্যোক্তা। এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল বেলখহায়াত বলেন, ব্যবহার করা সহজ হওয়ায় এপর্যন্ত ৫০ হাজার দোকানি তার অ্যাপটির সুবিধা নিচ্ছেন। এই অ্যাপ শুধু হিসাবই রাখে না, যারা বাকিতে পণ্য কিনেছেন তাদের নির্দিষ্ট সময়ে টাকা দেওয়ার তাগাদাও পাঠায়।
চারির মাধ্যমে দোকানিরা আগেভাগে পণ্যের অর্ডার দিয়ে রাখতে পারেন। টাকা দিতে হয় পণ্য এসে পৌঁছানোর পর। এমন অ্যাপ ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশেও সৃষ্টি করেছে নতুন সম্ভাবনা। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকাসহ উন্নয়নশীল দেশের শত কোটি মানুষের নিত্য কেনাকাটায় এসব পরিবর্তন হবে বৈপ্লবিক।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক