রিটার্নের সংখ্যা বাড়লেও কর আদায় কমেছে ৭২৯ কোটি টাকা
জরিমানা ছাড়া ব্যক্তি করদাতাদের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে গত রোববার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগ হিসাব করে দেখেছে, গতবছরের একই সময়ের তুলনায় রিটার্ন জমা বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ। স্বাভাবিক বিবেচনায়, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয়করের পরিমাণও বাড়ার কথা। কিন্তু আদায় বাড়েনি, বরং কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিলো, যা এ বছর বাতিল করা হয়েছে। এ কারণে চলতি বছর আয়কর আদায়ের পরিমাণ কমে গেছে। অন্যদিকে কোভিডের কারণে ২০২০-২০২১ সালে মানুষের আয় কমে যাওয়াও সার্বিকভাবে আয়কর আদায় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।
এনবিআরের একজন ট্যাক্স কমিশনার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছর আমার ট্যাক্স জোনে প্রায় তিনশ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ধারায় (অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সংক্রান্ত ধারা) টাকা প্রদর্শন করেছেন। এথচ এবার আমার জোনে এখন পর্যন্ত একজনও এই ধারায় কালো টাকা বিনিয়োগে আনেননি।"
এছাড়া কোভিডের কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়াও আদায় কমার একটি কারণ হতে পারে বলে জানান তিনি।
অতীতের বছরগুলোতে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করের পাশাপাশি ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হতো। ওই সময় সর্বোচ্চ করের হার ছিলো ৩০ শতাংশ। আয়কর বিভাগ প্রশ্ন না করলেও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) অন্যান্য সংস্থার প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিলো। ফলে এসব কারণে করদাতারা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাতেন না।
করোনা পরিস্থিতিতে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর লক্ষ্যে টাকার প্রবাহ বাড়াতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সরকার মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেয়। শুধু তাই নয়, ওই টাকার উৎস সম্পর্কে কোন সংস্থাই প্রশ্ন করতে পারবে না বলেও আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়।
এরপর গত বছর এযাবতকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ কালো টাকা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, গত করবর্ষে প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তি ২০,৫০০ কোটি টাকা সাদা করেছেন, যার বিপরীতে এনবিআর কর পেয়েছে ২০৬৪ কোটি টাকা।
তবে পরবর্তী অর্থবছর এসে ওই বিশেষ সুযোগ বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে যথারীতি কালো টাকা সাদা করার পরিমাণও একেবারেই কমে যায়। অবশ্য সোমবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সর্বশেষ কালো টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া যায়নি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, "কোভিডের কারণে মানুষের আয় কমে গেছে, ফলে আয়কর কমা অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া আয়কর কমার একটি কারণ হতে পারে। তবে আয়কর আদায় কমলেও এভাবে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দেওয়াই যৌক্তিক।"
প্রতিবছর জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরের করদাতা সনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) আয় ও ব্যয়ের হিসাব নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা, যা ট্যাক্স রিটার্ন নামে পরিচিত।
কয়েক বছর আগে এই দিনটিকে ট্যাক্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেছে এনবিআর। তবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে গত বছর নিয়ম ভেঙ্গে এনবিআর সময়সীমা এক মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করেছিলো, যা এবারও করা হয়। তবে ৩১ ডিসেম্বর সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় পরবর্তী খোলার দিন অর্থাৎ ২ জানুয়ারি রবিবার অফিস খোলার দিন কোন ধরণের জরিমানা না দিয়ে কর দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
এনবিআরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন জমা হয়েছিলো প্রায় ২১.৫ লাখ, যার বিপরীতে আয়কর আদায় হয়েছিলো ৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। চলতি বছর প্রায় একই সময় পর্যন্ত রিটার্ন জমা দিয়েছেন প্রায় ২৩ লাখ টিআইএনধারী, অথচ কর আদায় হয়েছে সোয়া তিন হাজার কোটি টাকার মত।
এছাড়া ৩ লাখ ৬২ হাজার টিআইএনধারী পরবর্তী রিটার্ন জমা দেবেন বলে আয়কর বিভাগের কাছে সময়ের আবেদন জমা দিয়েছেন, যা টাইম প্রেয়ার নামে পরিচিত। এসব টিআইএনধারীকে সম্ভাব্য রিটার্ন জমা বলে মনে করে আয়কর বিভাগ।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দেশে বর্তমানে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৬৭ লাখ। অবশ্য এনবিআরের হিসাব বলছে, গত জুন পর্যন্ত টিআইএনধারীর সংখ্যা ছিলো ৬২ লাখ ৭৭ হাজার। জুন পর্যন্ত টিআইএনধারীদের উপরই গত বছরের ট্যাক্স রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। সেই হিসেবে ৬৩ শতাংশ টিআইএনধারী এখন পর্যন্ত তাদের রিটার্ন জমা দেন নি।