শূন্য থেকে শুরু করে, পাবনার প্রিন্স কেমিক্যাল এখন বহু নারীর কর্মক্ষেত্র
কারখানা শ্রমিকের চাকরি হারানোর পর ১৯৯৮ সালে স্বামী-স্ত্রী মিলে চক-পেন্সিল বানানো শুরু করেছিলেন এম এ মান্নান; পুঁজি ছিল মাত্র আড়াইশো টাকা। আজ সেটি পাবনার বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় বিশ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্যাক্টরি, যার নাম 'প্রিন্স কেমিক্যাল লিমিটেড' এবং এর বার্ষিক আয় ৮০ কোটি টাকা।
কিন্তু নিজেদের জীবনের প্রথম দিকের সংগ্রামের কথা ভুলে যাননি এই ফ্যাক্টরির মালিকেরা। সমাজের নিঃস্ব মানুষদের চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে চলেছেন তারা। আর এভাবেই স্বল্প পরিসরের 'প্রিন্স কেমিক্যাল' নারী ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য হয়ে উঠেছে এক আশীর্বাদ। এই মুহূর্তে ফ্যাক্টরির মোট ১১৬ জন কর্মীর মধ্যে প্রায় ১০০ জনই নারী এবং এদের অনেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকবান্ধব পরিবেশে কাজ করছে নারী শ্রমিকেরা। কোনো চাপ নেই প্রশাসন থেকে। চারটি স্তরে যে যার দ্বায়িত্ব পালন করে চলেছে তারা। তাদের ফোরম্যানদের একজন হলেন নারী।
কথা হলো কোম্পানীর নারী শ্রমিক পারুল রানী সাহার সাথে, তিনি জানালেন, "এখানে কাজের পরিবেশ ভাল। শ্রমিকদের ন্যায্য হাজিরা দেয়া হয়। এখানে প্রতিবন্ধী অসহায় নারীরা কাজ করে। শাহিদা খাতুন নামের এক প্রতিবন্ধী নারী এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছে। কাজ করে টাকা জমানোর পর সে বিয়ে করে স্বামী নিয়ে সংসার করছে।"
কারখানার আরেক কর্মী সোমা বলেন, "আমরা শারীরিকভাবে অক্ষম হলেও প্রশাসন আমাদের সাথে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করে না। তারা আমাদের কোনো চাপ দেয় না। আমাদের সমান মজুরি দেওয়া হয়।"
ফ্যাক্টরি ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠানটির দুটি ডিপো রয়েছে। উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রিকো-৫ সোপ পেন্সিল, রিকো-৫ সোপ চক, প্রিন্স গ্লাস মার্কেটিং পেন্সিল, আফসানা গ্লাস, ডায়মন্ড গ্লাস মার্কেটিং পেন্সিল, প্রিন্স টেইলরস, ভ্যানিসেবল, ইংলিশ চক গার্মেন্টস শিল্পের অ্যাক্সেসরিজ হিসেব স্থান দখল করেছে।
জানা যায়, পাবনার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত পণ্য ডিপোতে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে ডিলাররা সেগুলো ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করেন।
সফলতার পথে মান্নানের যাত্রা
প্রিন্স কোমিক্যাল কোম্পানী লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান জানান, তিনি ১৯৮৭ সালে পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর ক্রিসেন্ট টেক্সাইল কোম্পানী লিমিটেডের ডিজাইন ও প্রিন্টিং সেকশনে একজন কর্মী হিসেবে যোগ দেন। সামান্য বেতনে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে কাজ করেন। লোকসানের কারণে কারখানাটি একসময় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
চাকরি হারানোর পর সামান্য পুঁজি নিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে চক পেন্সিল তৈরীর কাজ আরম্ভ করেন। তাদের বানানো চক স্থানীয় বাজারের টেইলরিং দোকানগুলোতে বিক্রি করতেন।
তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুনগত মান ভাল হওয়ায় ধীরে ধীরে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে সারা দেশে। এক পর্যায়ে তারা ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণও পান।
এম এ মান্নান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কিছু গার্মেন্ট ফ্যাক্তরি থেকে অর্ডার পাওয়ার পর আমি কিছু কর্মী নিয়োগ দেই।" আর এটাই ছিল তার ব্যবসায়ের টার্নিং পয়েন্ট।
পরবর্তীতে তারা পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার জন্য কিছু ডিলারের সাথে চুক্তি করেন। করেন। বর্তমানে টঙ্গীর তুসকা ফ্যাশন ও সাভারের আল মুসলিম গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে সরাসরি গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সরবরাহ করে থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের শুরু থেকে মেশিনারীজ ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজ আমদানী করা হতো চীন থেকে। এ কারণে উৎপাদন খরচও বেশী হতো।
মান্নান বলেন, "এজন্যেই প্রিন্স কেমিক্যাল কোম্পানি বিশেষভাবে গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত চক-পেন্সিল উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত নেয়।"
ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ এম এ মান্নান ২০১২ ও ২০১৫ সালে ন্যাশনাল প্রোডাকটিভিটি এন্ড কোয়ালিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৪ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি শিল্প উন্নয়ন পুরষ্কারেও ভূষিত হন। এছাড়াও ২০১৭ সালে তিনি বিআইডি কোয়ালিটি কনভেনশান, জেনেভা'র জন্য মনোনীত হন।
পাবনা বিসিক শিল্প নগরীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ পর্যায়ে পৌছেছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যন্য প্রতিষ্ঠানের মত বিসিক থেকে তাকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে।"