শিল্প স্থাপনে নিবন্ধনের শর্ত পাঁচটিতে নামিয়ে আনার পক্ষে এফবিসিসিআই
দেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে নিবন্ধনের কিংবা সনদের বিদ্যমান শর্ত শিথিল করার পক্ষে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।
বর্তমানে শিল্প স্থাপনে ক্ষেত্রভেদে সর্বোচ্চ ৩৩ ধরণের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিবন্ধন, সনদ কিংবা অনুমতি নিতে হয়। শিল্প স্থাপন সহজ করতে এটি পাঁচটিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। এগুলো হলো জমি, ভবন, অগ্নি, পরিবেশ ও ট্যাক্স সংক্রান্ত সনদ।
এছাড়া বছর বছর এসব নবায়নের শর্ত বাতিল করা এবং চার্জ ও অন্যান্য কর আদায়ের পরিবর্তে কেবল সুনির্দিষ্ট সেবার বিপরীতে প্রকৃত প্রশাসনিক খরচভিত্তিক হার ধরা, কুটির শিল্পের বিনিয়োগের সীমা বিদ্যমান ১০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত উন্নীত করা এবং এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাপক শুল্ক কর ছাড়সহ বেশকিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
নতুন করে হতে যাওয়া শিল্প নীতিতে, যা শিল্প মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করছে, অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চলতি সপ্তাহের শুরুতে এসব প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। ইতিমধ্যে নতুন শিল্প নীতির খসড়া তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালে এই নীতি চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও কোভিডসহ বিভিন্ন কারণে তা পিছিয়ে যায়। এর আগে ২০১৬ সালে শিল্প নীতি প্রণয়ন করা হয়, যা এখনো বলবৎ রয়েছে।
এছাড়া অন্যান্য সংস্থাগুলোকে শিল্প নীতি মানার বাধ্যবাধকতায় আনার জন্য এর আইনি ভিত্তি দেওয়ার প্রস্তাবও দেয় সংগঠনটি।
এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে কোন কোন ক্ষেত্রে ৩৩ ধরণের লাইসেন্স নিতে হওয়ায় শিল্প স্থাপনে ৬ মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে, যা সময়ের পাশাপাশি খরচও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এত সংস্থা থেকে নিবন্ধন ও সনদ নিতে হওয়ায় দুর্নীতির সুযোগ থাকছে। দুর্নীতির সুযোগ রাখতেই এই ব্যবস্থাকে এত জটিল করা হয়েছে।
স্থানীয় বিনিয়োগ ও এফডিআই আনতে হলে এটি সহজ করা দরকার। কেননা একজন বিনিয়োগকারী যদি দেখেন ভিয়েতনামে ৫টি লাইসেন্স দিয়ে শিল্প স্থাপন করা যায়, আর বাংলাদেশে ৩৩টির প্রয়োজন হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আসবেন কেন?"
তিনি বলেন, "ভিয়েতনামে তো ৫টি লাইসেন্স দিয়ে শিল্প স্থাপনে সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়?"
অর্থনীতিবিদরাও দেশের ব্যবসা ও শিল্প স্থাপনকে সহজ করতে নিবন্ধন সংক্রান্ত জটিলতা কমিয়ে সহজ করার কথা বলছেন।
অবশ্য এফবিসিসিআইয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সব শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেই যে ৩৩ ধরণের লাইসেন্স বা পারমিট নিতে হয়, তা নয়। কিছু শিল্পের ক্ষেত্রে আরো কমও প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ শিল্পের ক্ষেত্রেই গড়ে ১৫ থেকে ২০ ধরণের লাইসেন্স, সনদ ও পারমিট নিতে হয়।
এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবে স্থানীয় বিদেশি বাজারমুখী সামগ্রিক উৎপাদনশীল শিল্প খাতের বিপরীতে মাত্র কয়েকটি অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত না করে প্রদেয় শিল্প সহায়ক সব সুবিধা সব খাতের জন্য অবারিত করার কথা বলা হয়।
এছাড়া জমি অধিগ্রহণ এবং সব শিল্প নগরীর প্লট বরাদ্দের নীতিমালা সহজ করার জন্য স্থায়ী প্রক্রিয়া গ্রহণ করে উদ্যোক্তাদের আবেদনের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা, সব নিবন্ধন বা সনদ বা সেবা বাবদ বার্ষিক চার্জ শুল্ক বা আয়কর হিসেবে আদায়ের পরিবর্তে কেবল সুনির্দিষ্ট সেবার বিপরীতে প্রকৃত প্রশাসনিক খরচভিত্তিক হার নির্ধারণ করার কথা উঠে এসেছে প্রস্তাবে।
এছাড়া পিছিয়ে থাকা এলাকায় বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রণোদনা হিসেবে বিভিন্ন শুল্ককর ও ফি বাতিল করা এবং বিনিয়োগের উপর নির্দিষ্ট হারে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়াও বিনিয়োগকারীদের অর্থায়ন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে 'ব্যাংক ক্লায়েন্ট সম্পর্ক' বিষয়ে ব্যাংকের ভূমিকা স্পষ্টীকরণ করে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সহজ করার কথাও বলা হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ব্যবসা সহজ করার জন্য অবশ্যই আমাদের লাইসেন্স বা পারমিট সংক্রান্ত জটিলতা কমিয়ে তা সহজ করতে হবে। এই লাইসেন্স বা সনদের সংখ্যা পাঁচটি হবে নাকি আরো বেশি হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
"কিন্তু বাংলাদেশে মান্ধাতার আমলের কাগজ-ভিত্তিক প্রক্রিয়ার এতো শর্ত আমাদের ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে দুর্বল অবস্থানে রেখেছে, যা অতীতে বিভিন্ন সময়েই বলা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এখন অনেক কিছুই অনলাইন মাধ্যমে হচ্ছে, আমাদের সে সুবিধা নিতে হবে।"
বাংলাদেশে ব্যবসা করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল বলে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টের (যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে) ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম।