সিরামিক শিল্পে বড় কর্পোরেটদের অংশগ্রহণ বাড়ছে
দ্রুত নগরায়ণ, বৈচিত্র্যময় আবাসন এবং জনগণের খরচযোগ্য আয় বৃদ্ধি: এসব কারণে ২০ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধির সাথে দেশের সিরামিক বাজার ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশিতে উন্নীত হয়েছে।
সিরামিক টেবিলওয়্যার, স্যানিটারিওয়্যার এবং টাইলসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বৃহৎ সংস্থাগুলিকে বাজারে প্রবেশে উৎসাহিত করেছে; প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
নিত্যপণ্য প্রস্তুতকারক মেঘনা গ্রুপ, এক সময়ের তামাক শিল্পের জায়ান্ট আকিজ গ্রুপ এবং কৃষি-ব্যবসা ও প্লাস্টিক প্রস্তুতকারক প্রাণ-আরএফএল সবাই এখাতে উৎসাহী। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ নিয়ে সম্প্রতি টাইলস বাজারে প্রবেশ করেছে মেঘনা গ্রুপ। আর আকিজ গত মাসে টাইলস তৈরিতে উজ্জ্বল রেকর্ড করার পর- টেবিলওয়্যারে উৎপাদন প্রসারিত করেছে।
গত ছয় বছরে ১০০ শতাংশ প্রসারিত সিরামিক বাজার নিয়ে উদ্দীপ্ত প্রাণ-আরএফএল। কোম্পানিটি প্রাথমিকভাবে টাইলস তৈরি করবে বলে বাজার সূত্রে জানা গেছে।
গত ছয় বছরে সিরামিক বাজারে শেলটেক, ডিবিএল এবং গ্রেটওয়াল সিরামিকের মতো পাঁচটি বড় কোম্পানি অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা কোটি টাকা বিনিয়োগ করে– এতে মোট বাজার বিনিয়োগ ১০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মোঃ সিরাজুল মোল্লা টিবিএস'কে বলেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বড় বড় কোম্পানিগুলো সিরামিক বাজারে আসছে।
তার মতে, 'স্থানীয় বাজার এখন বেশ প্রতিযোগিতামূলক। আমাদের দেশে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। একসময় সিরামিক টাইলসের ব্যবহার দেখা যেত নগরকেন্দ্রিক বাসাবাড়িতে। এখন গ্রামেগঞ্জে- প্রান্তিক পর্যায়েও টাইলসের ব্যবহার হচ্ছে। এক কথায়, টাইলস এখন একটি অপরিহার্য পণ্যে পরিণত হয়েছে।'
ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিষয়ে সিরাজুল ইসলামের সাথে একমত পোষণ করে, মেঘনা সিরামিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক ইফতাখার আলম বলেন, সারা দেশে দ্রুত নগরায়ন-ই হচ্ছে টাইলসের বাজার বৃদ্ধির মূল কারণ।
বিসিএমইএ'র তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৬ হাজার কোটি টাকার টাইলস বিক্রি হয়েছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর হিস্যা ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, আর আমদানি করা টাইলস বিক্রি হয়েছে ৭০০ কোটি টাকার। এছাড়া, টেবিলওয়্যার ও বাথরুম ফিটিংসের (স্যানিটারিওয়্যার) সম্মিলিত বিক্রি ১ হাজার কোটি টাকা।
এখন চলছে সম্প্রসারণের সময়:
টাইলসে নতুন বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সম্প্রতি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে শেলটেক ও মীর সিরামিকসের মতো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি।
তিন দশকের বেশি সময় আবাসন খাতে নেতৃত্ব দেওয়া শেলটেক তাদের ভোলার কারখানায় ২০১৮ সালে একটি ইউনিটে মেঝে (ফ্লোর) ও দেয়ালের (ওয়াল) টাইলস উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে তাদের দৈনিক টাইলস উৎপাদন ক্ষমতা ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট। চলতি বছর চালু হবে আরও দুটি উৎপাদন ইউনিট, তাতে দৈনিক সক্ষমতা ৪ লাখ ৭৫ হাজার বর্গফুটে উন্নীত হবে।
শেলটেক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ বলেন, 'আবাসনে মানসম্মত ব্যবসা করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে শেলটেক। টাইলসে প্রস্তুতেও একই মান ধরে রাখতে চাই।'
দুটি উৎপাদন ইউনিট নিয়ে, ২০১২ সালে টাইল তৈরির যাত্রা শুরু করে আকিজ সিরামিকস। তাদের উৎপাদন লাইন এখন পাঁচটিতে উন্নীত হয়েছে।
আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসকে বশিরুদ্দিন জানান, আকিজের নতুন লাইনগুলোর প্রত্যেকটি সক্ষমতায় প্রথম দিকের ৭-৮টি লাইনের সমান।
'আমাদের স্যানিটারিওয়্যারের কারখানা সম্ভবত দেশের বৃহৎ। আশা করছি টেবিলওয়্যারের নতুন যাত্রায়ও ভালো করবো।'
বাজারের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ডিবিএল সিরামিকসও টাইলস উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।
যৌথ উদ্যোগ, বিদেশি প্রযুক্তি:
দীর্ঘদিন ধরেই থাইল্যান্ডের কট্টো ব্র্যান্ডের স্যানিটারিওয়্যার বাজারজাত করছে গ্রেটওয়্যাল সিরামিকস। কট্টো সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জে ২০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে একটি কারখানা স্থাপন করেছে। গ্রেটওয়াল এবং কট্টোর যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত এই কারখানায় চলতি বছরে উৎপাদন শুরু হতে চলেছে।
গ্রেটওয়াল সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোঃ শামসুল হুদা বলেন, 'আবাসন ব্যবসার বৈচিত্রের কারণে ভালো মানের স্যানিটারিওয়্যারের চাহিদা বেড়েছে। দেশের চাহিদার কথা চিন্তা করেই কট্টোর সিরামিকস উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।'
গ্রেটওয়াল ছাড়াও, বেশ কয়েকটি স্থানীয় কোম্পানি হয় বিদেশি ব্র্যান্ডের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে অথবা নিজস্ব উৎপাদন লাইনে বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আকিজ গ্রুপ জানিয়েছে, তারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিরামিক তৈরির জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
সিরামিক পণ্যের শীর্ষে টাইলস:
বিসিএমইএ'র তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৮টি সিরামিক তৈরির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি কারখানা স্যানিটারিওয়্যার, ২০টি টেবিলওয়্যার এবং বাকিগুলো টাইলস তৈরি করে।
মোট ৬ হাজার কোটি টাকার বাজারে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার টাইলস পণ্য বিক্রি হয়। তবে টাইলসের বাজারের ৬০ শতাংশেরও বেশি দখলে রয়েছে শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের।
প্রত্যেকে ১৬ শতাংশের বেশি বাজার দখল নিয়ে এ বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে আরএকে ও আকিজ। তারপর রয়েছে গ্রেটওয়াল, স্টার, আবুল খায়ের এবং মীর সিরামিকস।
পণ্যভেদে বাজার অংশীদারিত্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বিচার করলে- ১৮ শতাংশ বাজার দখল নিয়ে টেবিলওয়্যারে শীর্ষ অবস্থানে আছে বেক্সিমকো গ্রুপের শাইনপুকুর সিরামিকস। তারপর রয়েছে মুন্নু সিরামিকস, ফার সিরামিকস এবং স্টার সিরামিকস।
অন্যদিকে, স্যানিটারিওয়্যারের (বাথরুম ফিটিংস) বাজারে ৩০ শতাংশ দখল নিয়ে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আরএকে সিরামিকস। বাজারের অন্যান্য শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের সিরামিক, আকিজ, গ্রেটওয়াল এবং স্টার।
নীতি সমর্থন এখনও অধরা:
দেশের বাজারে সিরামিক খাত উদীয়মান তারকা হলেও, শুধু টেবিলওয়্যারেই সীমাবদ্ধ বাংলাদেশের রপ্তানি। উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি-নির্ভর কাঁচামাল অতিরিক্ত শুল্কে দেশে এনে পণ্য উৎপাদন করে- তা দিয়ে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়।
এছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বিদেশি টাইলস ব্যবহার হওয়ায়- তাতে পিছিয়ে পড়ছে স্থানীয় সিরামিক শিল্প।
সিরামিক প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, 'দুর্ভাগ্যবশত সিরামিক শিল্পের জন্য কাঁচামালের ওপর মোট শুল্ক-কর ফিনিশড পণ্যের চেয়েও বেশি।'
যার অর্থ ট্যারিফ নীতিতে সিরামিক আমদানি উৎসাহিত এবং স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে জানান সিরাজুল।
তিনি আরও বলেন, 'হাই-ভ্যালু টাইলস শিল্পে এখন ইউরোপীয় উৎপাদকরা ছড়ি ঘোরাচ্ছে। সরকার যদি স্থানীয় টাইলস উৎপাদকদের শুল্কমুক্ত (কাঁচামাল) আমদানি সুবিধা দেয়- তাহলে এই খাত রপ্তানি আয়ের ভালো উৎসে পরিণত হতে পারে।'