বেড়েছে উৎপাদন খরচ, কমেছে সক্ষমতা: বিপাকে উৎপাদনকারীরা
দেশব্যাপী রুটিন লোডশেডিংয়ে বিপাকে পড়েছে গোটা উৎপাদন খাত। কারখানাগুলোতে সার্বক্ষণিক উৎপাদন চালু রাখার ফার্নেস অয়েল দিয়ে জেনারেটr বা নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ব্যয় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ব্যয় বেড়ে গেছে জন্য বিভিন্ন শিল্প খাতে।
রুটিন লোডশেডিংয়ের মধ্যে ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ব্যয় বহন করার সক্ষমতা না থাকায় ১৯ জুলাই দেশব্যাপী বিদ্যুৎ রেশনিং কার্যকর হওয়ার পর ১০ দিনের ব্যবধানে অনেক কারখানাই বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে থেকেই আকাশচুম্বী ফ্রেইট চার্জ, সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইনপুট খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে ছিলেন তারা। এর মধ্যে চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট তাদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে।
চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকটে উৎপাদকরা কেমন বিপাকে পড়েছে, তার উদাহরণ দেয়া যাক এসিআই লিমিটেডের মাধ্যমে। ওষুধ, পশুর ওষুধ, সার, কীটনাশক, কৃষিপণ্য, ভোগ্যপণ্য, খাদ্যপণ্য, ইলেকট্রনিকস পণ্য, নিত্য ব্যবহার্য পণ্য, কৃষি ও বাণিজ্যিক যান, মোটরসাইকেল ইত্যাদি খাতে ২৫টির বেশি কোম্পানি রয়েছে এসিআই লিমিটেডের। গত ১০ দিনের লোডশেডিংয়ে সব খাতেই উৎপাদন ব্যয় ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে এই শিল্পগোষ্ঠীর।
এসিআই এগ্রিবিজনেস-এর প্রেসিডেন্ট ড. এফএইচ আনসারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যেসব কারখানায় ফার্নেস অয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেখানে খরচ বেশি হলেও উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাচ্ছে। যেখানে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই সেখানে প্রোডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে।'
ঢাকার বাইরের শিল্পগুলোতে দিনে তিন-চারবার পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, বাড়ি ও শিল্প উভয় জায়গাতেই সার্বিক বিদ্যুৎ সরবরাহ কমেছে ২ হাজার মেগাওয়াট বা ১২ শতাংশ।
নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের উৎপাদন কমেছে অন্তত ২০ শতাংশ। বেড়েছে উৎপাদন খরচ।
সিকম গ্রুপের (টিকে গ্রুপের একটি অংশ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, সিমেন্ট, ইস্পাত, ভোজ্য তেল, গ্লাস ও কাগজ কারখানার মতো ভারী শিল্পে মেশিন চালু করতেই অনেক সময় লাগে। এসব শিল্পে একবার কোনো উৎপাদন লাইন বন্ধ হলে তা আবার চালু করতে ৩০ থেকে মিনিট লেগে যায়।
এতে করে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে শুধু যে সময়ই নষ্ট হচ্ছে তা নয়, উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
গত এক সপ্তাহে তাদের উৎপাদন অন্তত ২০ শতাংশ কমেছে জানিয়ে আমিরুল হক অভিযোগ করেন, 'দিনে দুইবার বিদ্যুৎ যাওয়ার কথা থাকলেও তা তিন-চারবারও হচ্ছে।'
দেশের অন্যতম শীর্ষ উৎপাদন গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল। সিলেট, রংপুর, ঢাকাসহ সারা দেশে ২৩টির বেশি কারখানা রয়েছে গ্রুপটির।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, 'বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে এখন আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা আমাদের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।'
সরকারের কাছে শিল্প খাতকে চলমান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানান তিনি।
লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কমেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগ্রুপ আকিজেরও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আকিজ গ্রুপের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, 'এরকম বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি চলতে থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।'
পোশাক খাতের কঠিন সময়
তুসুকা গ্রুপের চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল দীপু বলেন, 'মহামারির সময়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার চেয়ে কঠিন সময় পার করছি আমরা। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘাটতির কারণে পূর্ণ সক্ষমতায় কারখানা চালাতে অনেক উৎপাদনকারী চ্যালেঞ্জে পড়ছেন।'
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, 'অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে আমাদের উৎপাদনকেন্দ্রগুলো বিপাকে পড়ছে। এতে সময়মতো শিপমেন্টও কঠিন হয়ে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা শিপমেন্টের ডেডলাইন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিছু পণ্য এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে পাঠাতে হয়।'
আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতারা ছাড় চাইছে। এতে উৎপাদনকারীরা লোকসানে পড়বে।'
চলমান বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় তারা সীমিত পরিসরে ডিজেলচালিত জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান রাকিব।
তিনি জানান, অতিরিক্ত খরচের কারণে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এতে বিশ্ববাজারে তাদের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নারায়ণগঞ্জভিত্তিক একজন নেতৃস্থানীয় স্পিনিং মিল মালিক টিবিএসকে বলেন, তার মিলে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন ১৫ পিএসআই (পাউন্ডস পার ইঞ্চি), কিন্তু ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকে তারা ১.৮ থেকে ৩.২ পিএসআই চাপ পাচ্ছেন।
এর ফলে তিনি উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
ইস্পাত ও সিরামিক কারখানায় সংকট বাড়ছেই
চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে বড় ধাক্কা খেয়েছে ইস্পাত ও সিরামিক কারখানাগুলো।
গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে দেশের বৃহত্তম টাইলস উৎপাদনকারী গ্রেট ওয়াল সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এখন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে সংকট আরও বেড়েছে কোম্পানিটির।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং গ্রেট ওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল হুদা টিবিএসকে বলেন, 'গ্যাসের চাপ কম থাকায় আমরা এক শিফটে কারখানা চালাচ্ছি। তার সঙ্গে নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখন আমাদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, কারণ উৎপাদন খরচও ২০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে।'
ইস্পাত খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত টিবিএসকে বলেন, 'দৈনিক ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার পরিবর্তে আমরা পাচ্ছি ১০০ মেগাওয়াট।'
ফার্নেস অয়েল দিয়ে নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরবরাহ ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করায় উৎপাদন খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এ অবস্থায় উৎপাদন কমিয়ে কারখানা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ আমরা বলতে পারছি না।'
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের উত্তাপ টের পাচ্ছে বড় ও ছোট শহরগুলোর ফ্রোজেন ও ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো। লোডশেডিংয়ের সময় দোকানগুলোতে কোনো গ্রাহক যাচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকলে এসব খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়ে যায়।
রাজধানীর মগবাজারের দিলু রোডের তামান্না ফাস্ট ফুডের ম্যানেজার জানান, লোডশেডিংয়ের সময় দোকানে জুসার ও মাইক্রোওয়েভ ওভেন চালানো যায় না বলে সব বিক্রি বন্ধ থাকে।
এদিকে বিদ্যুৎ ছাড়া যন্ত্রপাতি চালানো সম্ভব না হওয়ায় লোডশেডিংয়ের কারণে সব ধরনের নির্মাণকাজের গতি কমে গেছে।
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, 'লোডশেডিংয়ের সময় আমরা ডিজেলচালিত পাওয়ার জেনারেটর ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এ কারণে আমাদের খরচ বাড়ছে।'
যাদের জেনারেটর নেই তাদের কাজ বন্ধ রাখতে হয়। এর ফলে ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান আব্দুল আউয়াল।