আয় না হলে অগ্রিম কর আদায়ের বিপক্ষে এফবিসিসিআই
আয় না হলে ব্যক্তি বা কোম্পানির কাছ থেকে অগ্রিম কর কর্তন না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)।
সংগঠনটি বলছে, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নীতি হচ্ছে, করযোগ্য স্বত্ত্বার আয়ের উপর কর। এ বিবেচনায় প্রস্তাবিত আয়কর আইনে বেতন, ফি, সুদ ও ডিভিডেন্ড ছাড়া অন্য যে কোন লেনদেন বা প্রাপ্তির উপর উৎসে কিংবা অগ্রিম আয়কর আরোপ না করার প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রস্তাবিত নতুন আয়কর আইনের উপর সংগঠনটি নিজেদের মতামত দিতে গিয়ে এ বিষয়টি সামনে এনেছে। দেশের সব ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বারের মতামত এবং আয়কর আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে এ প্রস্তাব তৈরি করে গত বুধবার তা এনবিআরে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
আয়কর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনের অবস্থানের সঙ্গে একমত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
ব্যবসায়ী, বিদেশী বিনিয়োগকারী ও রিসার্চ বডির পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে অগ্রিম আয়কর কর্তন হওয়ায় তা কোম্পানির এফেক্টিভ ট্যাক্স রেট বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশে বর্তমানে ১১১টি খাতে ট্যাক্স ডিডাকশন এট সোর্স (টিডিএস), অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি), মিনিমাম ট্যাক্স হিসেবে আয়কর কর্তন করা হয়। এর মধ্যে অন্তত ৪১টি খাতে পরবর্তীতে ওই ট্যাক্স সমন্বয় কিংবা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমনকি কোন প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও আগে কর্তিত কর ফেরত পায় না। আবার যাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন) নেই কিংবা আয়কর রিটার্ন জমা দেন না, তাদেরও অগ্রিম দেওয়া কর ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেই।
বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। তারা বলছেন, দেশে প্রত্যাশিত হারে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) না আসার পেছনে এটি অন্যতম কারণ।
বর্তমানে কমার্শিয়াল ইমপোর্টের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ এআইটি কর্তন করা হয়। শিল্প ও সেবা খাতের টার্নওভারের ওপর মিনিমাম ট্যাক্স হিসেবে ০.৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ আদায় করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন খাতে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হয়।
১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বর্তমান আয়কর ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। তবে ২০১৩ সালে সরকার নতুন আয়কর আইন করার উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে বিভিন্ন কারণে নতুন আইনের প্রণয়ন পিছিয়ে যায়। বিস্তর আলোচনার পর গত বছরের শেষ দিকে নতুন আইনের খসড়া প্রকাশ করে এনবিআর। এর ওপর ব্যবসায়ী সহ সংশ্লিষ্টদের মতামতও চাওয়া হয়। আগামী বাজেট অধিবেশনে আইনটি পাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব সঠিক। এআইটি, টিডিএস, মিনিমাম ট্যাক্স বা ভ্যাটের আদলে আদায় করা অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি) আদায় করা ঠিক নয়। কারণ আমাদের দেশে রিফান্ড ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। যার কারণে ইফেক্টিভ ট্যাক্স রেট বেড়ে যায়, যা ব্যবসায়ীদের কস্ট অব প্রোডাকশন বাড়িয়ে দেয়।"
এনবিআরের আয়করনীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিমও বলেন, এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব যৌক্তিক।
তবে তিনি বলেন, "পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও মিনিমাম ট্যাক্স রয়েছে কিন্তু সেখানে রিফান্ড ব্যবস্থা স্বচ্ছ। কিন্তু আমাদের এখানে রিফান্ডের সুযোগ কম থাকায় কোম্পানির ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। নতুন আইনে সবার জন্য না হলেও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি বিবেচনা করা উচিত।"
এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাবে একই আয়ের উপর একাধিকবার আয়কর আদায় পরিহার করা, করযোগ্য নিট আয়ের উপর কর আরোপ করা, অনুমোদিত ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিসক্রিশনারি প্রসেস পরিহার করা, যেসব করদাতার (মূলত ব্যবসায়ী) হিসাব রাখার ক্ষমতা নেই তাদের গ্রস প্রফিট নির্ধারণ, এনবিআর ও পেশাদার হিসাববিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমিটির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহ বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ হলেও অগ্রিম করের কারণে তা ৪৫ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে
এনবিআরের সঙ্গে প্রাক বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রতিনিধিরা অগ্রিম আয়কর, উৎসে কর কর্তন এবং মিনিমাম ট্যাক্স প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।
তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব কারণে কর্পোরেট ট্যাক্সরেট কমানোর সুবিধা নিতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।
গত দুই বছরে কর্পোরেট করহার ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩০% এ আনা হলেও আলোচ্য কারণে এফেক্টিভ ট্যাক্স রেট ৪০-৪৫% হয়ে যাচ্ছে।
বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম এনবিআর আয়োজিত আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, উৎসে কর্তন হওয়া করের রিফান্ডের হার এক শতাংশেরও কম, যা উদ্বেগজনক।
অন্যদিকে বিডার পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর্পোরেট করহার বেশি হওয়ায় আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা বিরত থাকছেন।