রমজানে এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করবে সরকার
কোভিড পরিস্থিতিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমে যাওয়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আসন্ন রমজানে এক কোটি পরিবারকে দুই দফা ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করবে সরকার। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে সারাদেশে খোলা ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি।
জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তালিকাভুক্ত এক কোটি পরিবারের জন্য সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর সরবরাহ করবে।
প্রতিটি পরিবার রমজানের আগে একবার দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি মসুর ডাল ও এক কেজি ছোলা পাবে। আবার রমজানের মাঝামাঝি সময় থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত একই পরিমাণ পণ্য আরেক দফা দেওয়া হবে পরিবারগুলোকে। এছাড়া, কোনো কোনো এলাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ ও খেজুরও দেওয়া হবে। প্রতি দফায় এসব পণ্য পেতে দরিদ্র পরিবারগুলোর খরচ হবে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে এক সভায় কোভিডের সময় নগদ প্রণোদনা পাওয়া ৩৫ লাখ দরিদ্র কর্মহীন পরিবারকে টিসিবির ভর্তুকি মূল্যের পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করলে প্রধানমন্ত্রী রমজানে এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি) এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেছেন।
সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কোভিডে যখন দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে এবং বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে গেছে, তখন এক কোটি পরিবার, তথা প্রায় পাঁচ কোটি মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক। তবে, সঠিকভাবে উপকারভোগী বাছাই করাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।
এ এইচ এম শফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "কোভিডের সময় ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা পাওয়া ৩৫ লাখ পরিবারসহ রমজানে মোট এক কোটি পরিবারকে দুই দফা টিসিবির পণ্য সরবরাহ করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসেছে। সঠিকভাবে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও টিসিবি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।"
তিনি বলেন, "শব-ই-বরাত থেকে রমজান শুরুর আগ পর্যন্ত, এ সময়ের মধ্যে এক কোটি পরিবারকে প্রথম দফা এবং মধ্য রমজান থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা পণ্য সরবরাহ করা হবে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে উপকারভোগীদের তালিকা করে ফ্যামিলি কার্ড সরবরাহ করা হবে। নির্ধারিত সময়ে প্রতিটি পরিবারের মোবাইল ফোন নম্বরে এসএমএস পাঠানো হবে। সেই এসএমএসে উল্লেখ থাকবে তিনি কবে, কোথা থেকে তার জন্য বরাদ্দকৃত পণ্য সংগ্রহ করবেন।"
বর্তমানে সারাদেশে ৪৫০টি খোলা ট্রাকে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। তবে আগামী রমজান থেকে এভাবে পণ্য বিক্রি বন্ধ করবে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। কারণ ভর্তুকির খাদ্যপণ্য যাদের পাওয়ার কথা, এই পদ্ধতিতে তারা পণ্য পাচ্ছেন না; বরং যাদের পাওয়ার কথা নয়, তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য সংগ্রহ করছেন। তবে রাজধানীর প্রেসক্লাবসহ গুরুত্বপূর্ণ অল্প কিছু পয়েন্টে গুটি কয়েক ট্রাকে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখবে টিসিবি।
এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার এই বিশাল পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণে আজ মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে বৈঠক ডাকা হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াও উপস্থিত থাকবেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কোভিডকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈদ উপহার দেওয়ার জন্য ৫০ লাখের তালিকা করা হয়েছিল। তালিকায় পেনশনার, সরকারি চাকরিজীবী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাম থাকায় তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে যাচাই-বাছাই শেষে ৩৫ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। পরে সড়ক পরিবহন, নৌ পরিবহন শ্রমিক, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আরও সাড়ে ৩ লাখ মানুষকে নগদ সহায়তা দেয় সরকার। ওই তালিকা সরকারের কাছে রয়েছে।
শফিকুজ্জামান জানান, রমজানে যে এক কোটি পরিবার খাদ্য সহায়তা পাবে, তার মধ্যে এই সাড়ে ৩৮ লাখ পরিবার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে, ঢাকা ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনভুক্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই তালিকার বাইরে রয়েছে। এখন এই দুই সিটির দরিদ্রদের তালিকা প্রণয়ন করা হবে। এতে প্রায় ১২ লাখ পরিবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ, যাদের বড় অংশই নগদ সহায়তাভুক্ত সাড়ে ৩৮ লাখের মধ্যে রয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে দরিদ্রদের তালিকা তৈরি করা হবে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে যাদের ফ্যামিলি কার্ড নেই, তাদেরকে কার্ড দেওয়া হবে। এসএমএস পাওয়ার পর নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত স্থানে গিয়ে খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করবেন তারা।
প্রতিবারের মতো এবারও রমজানে সারাদেশে ৭০০ ট্রাকে পণ্য বিক্রির পরিকল্পনা নিয়ে তেল, চিনি, খেজুর, ছোলা সংগ্রহ করছিলো টিসিবি। এখন এক কোটি পরিবারকে দুই দফায় পণ্য সরবরাহ করতে সংস্থাটিকে আরও বেশি পণ্য সংগ্রহ করতে হবে।
টিসিবির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে টিসিবির গুদামে ১৬ হাজার টন ডাল রয়েছে, আরও ২৪ হাজার টন ডাল সংগ্রহ করবে সংস্থাটি। বর্তমানে ২০ হাজার টন চিনি রয়েছে, যা বাড়িয়ে ৪০ হাজার টনে উন্নীত করতে হবে। টিসিবির গুদামে ২ কোটি লিটার ভোজ্যতেল রয়েছে, প্রয়োজন হবে চার কোটি লিটারের। এছাড়া, ১০ হাজার টন ছোলা মজুদ আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পেঁয়াজের মওসুম শুরুর আগে দেশের বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার সময় টিসিবি পেঁয়াজ আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছিল। এখন সেসব পেঁয়াজ দেশে আসতে শুরু হয়েছে। আমদানি হওয়া এসব পেঁয়াজও সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে সারাদেশে ১২টি গুদাম রয়েছে টিসিবির। এসব গুদাম থেকে সারাদেশে ডিলারদের মাঝে পণ্য সরবরাহ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে সংস্থাটি। নতুন পদ্ধতিতে যে ১২টি জেলায় গুদাম রয়েছে, গুদাম থেকে শুধু ওইসব জেলাতেই পণ্য সরবরাহ করা হবে। বাকি ৫২ জেলায় পণ্য সরবরাহ করা হবে জেলা প্রশাসক বা ডিসিদের পরিচালনায়। ডিসিরা পণ্য গ্রহণ করে উপকারভোগীর তালিকা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে পাঠাবেন। উপকারভোগীর সংখ্যা অনুযায়ী উপজেলা থেকে পণ্য পাঠানো হবে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায়। সেখান থেকে পণ্য সংগ্রহ করবেন উপকারভোগীরা।
ভোজ্যতেল ছাড়াও টিসিবি এখন খোলা চিনি, ডাল ও ছোলা বিক্রি করে। বস্তা খুলে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী মেপে বিক্রি করেন ডিলাররা। নতুন পদ্ধতিতে সব পণ্যই প্যাকেটজাত করা হবে। এতে সময় সাশ্রয়ের সঙ্গে অপচয়ও কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৯ ফেব্রুয়ারি জারি করা প্রজ্ঞাপনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জেলা প্রশাসকরা উপকারভোগীর সংখ্যা টিসিবিকে জানাবেন। টিসিবির পণ্য জেলা পর্যায়ে সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্ধারণ করবেন এবং জেলা প্রশাসকদের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবি নির্ধারিত গুদামে পণ্য পাঠাবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা তাদের বরাদ্দ পত্র অনুযায়ী পণ্য বুঝে নিয়ে রিসিভ কপি টিসিবিকে দেবেন।
উপকারভোগীদের মধ্যে টিসিবির পণ্য বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসকরা ক্রেতার সংখ্যা, বিক্রয়ের সময় ও স্থান নির্ধারণ করে কোন তারিখে, কোথায়, কতজন উপকারভোগীর মধ্যে পণ্য বিতরণ করা হবে, তার ক্যালেন্ডার করবেন। এই ক্যালেন্ডারের কপি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, পৌরসভার মেয়র, ওয়ার্ড কমিশনারদের দেবেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার পণ্য বিক্রির তারিখ, সময় ও স্থান সম্পর্কে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সকল মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য বিক্রির ৪ দিন আগেই ফ্যামিলি কার্ড হোল্ডারদের অবহিত করবেন।
তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের অনুপস্থিতির কারণে কোনো পণ্য অবিক্রিত থাকলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার/সহকারী কমিশনার (ভূমি) উপস্থিত নিম্ন আয়ের অন্য মানুষদের অনুকূলে ফ্যামিলি কার্ড ইস্যু করে তাদের কাছে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করবেন।
ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডভিত্তিক পণ্য বিক্রির জন্য পৃথক কমিটি থাকবে; কমিটিতে দুই জন করে পুলিশ সদস্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রতিটি উপকারভোগী পরিবারের জন্য তিন কপি ফ্যামিলি কার্ড তৈরি করবেন; এরমধ্যে এক কপি কার্ড অথরাইজড অফিসারের কাছে, এক কপি টিসিবির ডিলারের কাছে এবং এক কপি উপকারভোগীর কাছে থাকবে। পণ্য নেওয়ার সময় ডিলারের কাছে থাকা কপিতে উপকারভোগী 'বুঝিয়া পাইলাম' লিখে স্বাক্ষর করবেন এবং উপকারভোগীর কপিতে ডিলার 'বুঝাইয়া দিলাম' লিখে স্বাক্ষর করবেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান ও সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রমজানে এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য সরবরাহ করতে পারলে তা খুবই ভালো কাজ হবে। এটি সম্ভব হলে টিসিবির ট্রাকসেল বন্ধ হলেও কোনো সমস্যা হবে না। তবে উপকারভোগী সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।"
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। কোভিডের সময় অনেকের আয় কমে গেছে, আবার রমজানে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ারও প্রবণতা থাকে। এ পরিস্থিতিতে এক কোটি পরিবার কম মূল্যে এসব পণ্য পেলে তা খুবই ভালো হবে।"
তিনি বলেন, "রমজানে সার্বিকভাবে যেন পণ্যমূল্য না বাড়ে, সরকারকে সেদিকেও কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। নিত্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে, রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।"