অসম্পূর্ণ বাঁধ, বিপাকে সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকরা
মার্চ মাসের শুরুতে অতিবৃষ্টি আর অকাল বন্যা থেকে হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জের একমাত্র ফসল বোরো ধান রক্ষাত বাঁধ নির্মাণের কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় শঙ্কায় আছে এ অঞ্চলের কৃষকরা।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় বাঁধের কাজ, ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সুনামগঞ্জের নলুয়া হাওরপাড়ের কৃষক মুকাদ্দাস আলী বলেন, "ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে গেছে অথচ এখন পর্যন্ত বাঁধে মাটিই ফেলা হয়নি। মাটি ফেলে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। অথচ মার্চ থেকেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি ও অকাল বন্যা দেখা দেয়। ফলে এবারও ফসল নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি।"
বাঁধ নির্মাণ কাজ নিয়ে সুনামগঞ্জ হাওর এলাকায় সম্প্রতি জরিপ চালায় পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান এবং পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ জরিপের ফলাফলে জানা যায়, নির্ধারিত সময়সীমা শেষে মাত্র ৬৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, "এ পর্যন্ত অনেক বাঁধে মাটির কাজ শেষ হয়নি। মাটি দুরমুজ (কম্পেকশন) ও ঘাস লাগানো হয়েছে আরও কম সংখ্যক বাঁধে।"
"এছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ ভাগ ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি," বলেন তিনি।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রকল্প প্রাক্ষলন ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, হাওর থেকে দেরিতে পানি নামা ও ড্রেজার মেশিনের স্বল্পতার কারণে এমনটি হয়েছে। এছাড়া বাঁধের মাটির দুষ্প্রাপ্যতা এবং প্রকল্প গঠনে অনিয়মের কারণেও দেরি হচ্ছে।
বাঁধের কাজ নির্ধারিতে সময়ে শেষ না হওয়ায় ফসল নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বুধবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে মানবন্ধন করে 'হাওর বাচাঁও আন্দোলন' নামে একটি সংগঠন।
সংগঠনটির সদস্য সচিব হোসাইন শরীফ বিপ্লব বাঁধ নির্মাণে গাফিলতির জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
তবে বাঁধ নির্মানের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দাবি করেছে, বাঁধের কাজ এ পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে, বাকি কাজ ১০ মার্চের মধ্যে সম্পন্নের আশা পাউবো কর্মকর্তাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, "মাটি ফেলার কাজ মুটোমুটি শেষ। এখন বাঁধে ঘাস লাগানো ও কম্কেশনের কাজ চলছে। কৃষকদের শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, বৃষ্টি শুরুর আগেই কাজ শেষ হবে।"
"হাওরের পানি দেরিতে নামা, বৃষ্টি হওয়া এবং ইউপি নির্বাচনের কারণে কাজ শেষ হতে দেরি হচ্ছে," বলেন তিনি।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের হাওরের বিস্তৃর্ণ বোরো ফসল। সরকারী হিসেবে, বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওরের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
তবে কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিলো প্রায় দ্বিগুণ। সে বছর ফসলহানির পর পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
এরপর বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধের কাজ করানো হয়। পিআইসিতে প্রশাসনের কর্মকর্তা, কৃষকসহ স্থানীয় উপকারভোগীরাও রয়েছেন।
তবে এরপরও বাঁধ নিয়ে অভিযোগ ফুরায়নি। পিআইসির মাধ্যমে বাঁধের কাজ করানোতে কিছু বিপত্তিও দেখা গেছে। বাঁধের কাজের জন্য প্রথমে পিআইসিকে বরাদ্ধকৃত টাকা ২৫ শতাংশ দেওয়া হয়। বাকি টাকা মিলে কাজের শেষে। কিন্তু পিাইসির সদস্যদের বেশিরভাগ স্থানীয় কৃষক। নিজের পকেট থেকে বাঁধের জন্য টাকা খরচের সঙ্গতি নেই বেশিরভাগেরই। ফলে কাজে দেখা দেয় ধীরগতি।
জগন্নাথপুরের নলুয়া হাওরের ৬ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি ছাদিকুর রহমান জানান, সময়মত টাকা না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি তিনি।
"এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮শ' টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা পেয়েছি। এখন টাকা ধার এনে কাজ করাতে হচ্ছে।"
পাউবো'র সুনামগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবছর ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৫৩২.৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২৪ কোটি টাকা।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা পিআইসির সভাপতি মো. রায়হান কবির বলেন, "বাঁধ নির্মাণ কাজ আমরা সার্বক্ষণিক তদারকি করছি। দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছি। এব্যাপারে কোন অনিয়ম সহ্য করা হবে না।"
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, বছর বছর বাঁধ নির্মাণের বদলে উজানে ও ভাটিতে নদী খনন করা প্রয়োজন।